দেবযানী দত্ত: রামকিঙ্কর বেইজ কে আমি চোখে দেখিনি। আমার জন্মের পূর্বে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন।বলা বাহুল্য আমার প্রজন্মের কেউই তাঁকে সশরীরে দেখেনি।কিন্ত আগ্রহীরা তাঁর কথা শুনেছে, জেনেছে, পড়েছে।অদ্ভুত লাগে ভাবতে ১১৭ বছর আগে জন্মানো মানুষটির জীবন কেন বারবার রোমাঞ্চিত করছে এখনও?কি অদ্ভুত নতুন তিনি আজও, সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা মানুষ।রামকিঙ্কর মানেই অদ্ভুত এক ডার্কনেস। রামকিঙ্কর নামটি উচ্চারিত হলেই অদ্ভুত একটা মায়াবী আঁধার আর পর্দার পিছনে সেই গায়ে কাঁটা দেওয়া, দরাজ, জীবনের সব দুঃখকে পান করে হজম করে ফেলা সেই পরিচিত হাসিটি। যেটা বারবার শোনা যায় তাঁকে নিয়ে তৈরি হওয়া বিভিন্ন ডকুমেন্টরিতে।১৯০৬এর ২৫মে বাঁকুড়ার এক দরিদ্রপল্লীতে জন্ম হয় তাঁর। তাঁর পারিবারিক পদবী পরামানিক।তিনিই প্রথম বেইজ পদবী ব্যবহার শুরু করেন। দুবেলা খাবার জোটাই যেখানে একটা বড় চ্যালেঞ্জ ইস্কুল-পাঠশাল অবদি পৌঁছান সেখানে দুর্লভ আর ছবি আঁকা কিংবা মূর্তি তৈরি করা লাক্সারি। সৌভাগ্যবশত, কোনওক্রমে প্রথমটির ব্যবস্থা করা হয়েছিল।কিন্ত দ্বিতীয়টি?
পাশের পাড়ার বিখ্যাত প্রতিমা শিল্পী অনন্ত সূত্রধর।স্কুল থেকে ফেরার পরে বাড়িতে যখন তেমন কিছু করার মতো থাকত না রামকিঙ্কর যেতেন অনন্তের কাছে। প্রথম প্রথম নদী থেকে মূর্তির মাটি সংগ্রহ,খড় জোগাড় এইসব শ্রমের কাজই করে দিতেন।অনন্ত ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন এই বাচ্চা ছেলেটি শুধুমাত্র শ্রমের জন্য জন্মায়নি এর হাতের কাজ অসাধারণ। তখন থেকেই তিনি রামকিঙ্করকে কোনও মূর্তির কখনও অসম্পূর্ণ অংশ, কখনও হাত, মুখ এইসব গড়ার কাজ দিতে লাগলেন। কখনও রাধা-কৃষ্ণ কখনও কালী-শিব-দূর্গা এইসব গড়তে গড়তে বিকশিত হতে লাগল তাঁর প্রতিভা। বাড়িতে স্বাভাবিক ভাবেই কোনও সমর্থন বা উৎসাহ নেই তবুও ঘরের এককোণে বসে আঁকার কাজ চলতে থাকল। রং কেনার সামর্থ্য নেই, উনুনের কয়লা দিয়ে কালো, খড়িমাটি দিয়ে সাদা, শিমের পাতা দিয়ে সবুজ, পলাশ দিয়ে লাল.... বাহুল্যহীন আটপৌরে রঙে রঙিন হয়ে উঠতে থাকল তাঁর ক্যানভাসগুলো। অসহযোগ আন্দোলনের সময় কীভাবে যেন জড়িয়ে পড়লেন কংগ্রেসের সঙ্গে।অবশ্য প্রত্যক্ষ সংগ্রামে নয়, কখনও গান্ধীজি কখনও সি. আর. দাশ সহ আরও অনেক কংগ্রেস নেতার ছবি, ব্যানার এঁকেছেন নিজে হাতে। ছবি নিয়ে তারপর সে এক অদ্ভুত মগ্নতা এলো। বিষ্ণুপুরে তাঁর মামাবাড়ি। সেখানে থেকে প্রতিদিন টেরাকোটার মন্দিরের বিস্ময় মূর্তিগুলিকে দুচোখ ভরে দেখা শুধুই দেখা। বয়সে কিছু বড় বেলিয়াতোরের যামিনী রায়ও সেই সময় বিষ্ণুপুরে। তিনি তখন ক্যানভাস ছেড়ে সবে সবে পটচিত্রে মন দিয়েছেন। রামকিঙ্কর নেহাৎ বালক। যামিনী রায় তাঁর আঁকা দেখে বুঝেছিলেন এ ছেলে সাধারণ কোনও বালক নয়।এরপর ব্রাহ্ম এক্সিবিশনে দেখা 'প্রবাসী'পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনিই তাঁর আঁকা দেখে তাকে শান্তিনিকেতনে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। ম্যাট্রিকের পরীক্ষা না দিয়ে ১৯২৫ এ শান্তিনিকেতন আসা। শিক্ষক নন্দলাল বসু তাঁর ছাত্রের বিস্ময় প্রতিভা দেখে হয়ত কিছু ভয়ই পেয়েছিলেন।উপদেশ দিয়েছিলেন ফিরে যেতে, নতুন কিছুই শান্তিনিকেতনে তাঁর আর শেখার মতো নেই। তবুও কোথাও একটা থমকে গিয়ে বলেছিলেন 'এসেছ যখন দু-পাঁচ বছর থেকেই যাও।'এরপর পাঁচ দশক শান্তিনিকেতনে থেকে যাওয়ার পরে শেষ জীবনে রামকিঙ্কর মজার ছলে বলতেন 'সেই দু-পাঁচ বছর আমার আজও শেষ হলো না।'বলেই হা-হা রবে তার সেই জিষ্ণু হাসিটি হয়ত হেসে উঠতেন। না, শান্তিনিকেতন তাঁকে ছাড়েনি, তিনিও শান্তিনিকেতন ছাড়েননি। বরং নিয়ম ভাঙার নানা খেলাচ্ছলে শান্তিনিকেতন তাঁর ছোঁয়ায় পেয়েছিল এক অভূতপূর্ব রূপ। নন্দলালের অন্যতম প্ৰিয় এই শিষ্য তাঁর অবাধ্যও কম হননি। জলরঙের বদলে প্রথম তেলরঙের ব্যবহার, প্রতিকৃতি বা জড় পদার্থের বদলে জ্যান্ত মডেলের ব্যবহার....চলতেই লাগল নানা রকম প্রথা ভাঙার খেলা। কখনও তাঁকে পাওয়া যায় নিষিদ্ধপল্লীতে, কখনও সাঁওতাল পাড়ায়.... উদ্দেশ্য,পরবর্তী ছবির বা মূর্তির বিষয় বা মডেল খোঁজা।শান্তিনিকেতনে প্রথমে ছাত্র তারপরে কলাভবনের শিক্ষক। সবে সবেবিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠা শান্তিনিকেতন তখন মূর্তি বানানোর দামী পাথর যোগাতে অপারগ।কিন্ত বীরভূমের পর্যাপ্ত লাল মাটি, কাঁকর, বালি আর সিমেন্ট এইসব দিয়েই শুরু হল কাজ।সেইবার উপাসনা ঘরের সামনের অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টটিকে ঘিরে বাঁধল বিতর্ক।দেব-দেবী, স্বর্গের নট-নটী বা মহান ও বিখ্যাত মানুষদের মূর্তি ছাড়া তখনও এ দেশের মানুষ স্কাল্পচার দেখেনি যে। ফ্রান্স বা কিউবিস্ট অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট ফর্ম তখন অপরিচিত। প্রথম যে মানুষের ঘাড়ে নতুন কিছু চেনানোর দায়িত্ব পড়ে তাঁকে সমালোচনাও কিছু কম শুনতে হয়না। ব্যতিক্রম ঘটেনি রামকিঙ্করের ক্ষেত্রেও।ভারতকে প্রথমবারের মতো মর্ডান আর্ট চেনাচ্ছেন রামকিঙ্কর,সবাই যখন নিন্দে মন্দ করতে মুখর সমর্থন এসেছিল স্বয়ং গুরুদেবের কাছ থেকে। রবীন্দ্রনাথ একদিন তাঁকে কাছে ডেকে বললেন 'তুই তোর মূর্তি আর ভাস্কর্য দিয়ে আমাদের সবখানে ভরে দে,একটা শেষ করবি, সামনের দিকে এগিয়ে যাবি '।এরপর আর থামেননি রামকিঙ্কর। একের পর এক সৃষ্টি করে গেছেন। তাঁর ছাত্রী ছিপছিপে জয়া আপ্পাস্বামী কে মডেল করে গড়লেন 'সুজাতা', কখনও মাটি আর আলকাতরা দিয়ে গড়লেন বুদ্ধকে, কখনও মহাত্মাকে। তবুও খেটে খাওয়া সাধারণ চরম দরিদ্র মানুষগুলোর জীবন সংগ্রামের অ্যাপিল তিনি এড়াতে পারেননি কখনোই। তিনি নিজে সাঁওতাল না হলেও কি যে ভালোবাসতেন ওইসব পল্লীতে মিশতে, সময় কাটাতে। তাঁর তৈরি 'সাঁওতাল পরিবার ' 'the mill call' বা সাঁওতাল রমণী বা পুরুষদের জীবনযাত্রা বা ফিগারের অসংখ্য ছবি তারই প্রমাণ বহন করে চলেছে। যাঁরা তাঁকে সামনে থেকে দেখেছেন তাঁরা অদ্ভুত বিস্ময়ীভূত হয়েছেন কোনও মূর্তি বা ছবি তৈরির সময় তাঁর মগ্নতা নিয়ে। যখন যা তিনি বানাতেন তাতে ডুবে যেতেন একেবারে। নাওয়া খাওয়া ভুলে ঘন্টার পর ঘন্টা মৌন হয়ে তাকিয়ে থাকতেন ছবির দিকে,মূর্তির দিকে।কিন্ত ওই অবদিই। যখনই একটা সৃষ্টি সম্পূর্ণ হতো কি অদ্ভুত ভাবে সমস্ত মমত্ব থেকে সরে আসতেন তিনি, তখন সম্পূর্ণ উদাসীন। এমনই ছিলেন রামকিঙ্কর। জীবনে বহু নারী। তাঁদের থেকে যা যা পেয়েছেন হৃদয় মনের শরীরের সমস্ত অমূল্য সম্পদ একেবারে নিংড়ে নিয়েছেন তিনি। আর সেই সম্পদ প্রবাহিত করেছেন ছবিতে, মূর্তিতে।তাঁর কাজ গুলি বোধহয় তাই এত জীবন্ত। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও কাটাছেঁড়া কম হয়নি। বিয়ে না করেও রাধি নামের এক সাঁওতাল মহিলার সঙ্গে এক ছাদের তলায় বসবাস করতেন আজীবন।সেই নিয়ে শান্তিনিকেতনে জলঘোলা কম হয়নি। তিনি কিন্ত বরাবরের মতই অকপট থেকেছেন। সম্পর্ক লুকোননি, বিতর্ক লুকোননি। একজন বিস্ময় শিল্পীর অনন্য শিল্পপ্রতিভার থেকেও যখন বেশি মুখরোচক কিছু মানুষের কাছে তাঁর জীবনে কতজন নারী এসেছেন, তাঁদের সাথে তাঁর সখ্যতা কতদূর অবদি গড়িয়েছিল, তিনি ঠিক কত বোতল বাংলা মদ খেতেন প্রতিদিন, নিষিদ্ধপল্লীতে কি করতে যেতেন এইসব জানার তখন তাঁর আজীবনের দারিদ্র-কথা যে কম লোকেই জানবে তাই ই বোধহয় স্বাভাবিক।হ্যাঁ তাঁর ভালো চিকিৎসা করানোর টাকা ছিলোনা, হ্যাঁ উত্তরায়নের বাসগৃহের খড়ের ছাদটি ফুটো ছিল। বৃষ্টিতে যখন জল পড়ে ঘর ভেসে যেত শোবার জায়গাটি রক্ষা করার জন্য তাঁকে তাঁর অয়েল পেইন্টিং গুলোকেই উল্টো করে মশারির ওপরে ফেলে রাখতে হত।ডি. লিট বা পদ্ম-ভূষণ প্রাপ্তির থেকেও বড় প্রাপ্তি যার কাছে ছিল শান্তিনিকেতনে গুরুদেবের আশীর্বাদ তিনি শত অভাবেও সাঁওতালপাড়া,শান্তিনিকেতনের ছাত্র-ছাত্রী,রঙ্গমঞ্চ,কাঁকর-বালি-মোরাম মাটির রাস্তা,সোনাঝুরির জঙ্গল কিচ্ছু ছাড়তে চাননি কখনও। তাইত অসুস্থ হয়ে ১৯৮০ র মার্চে যখন এস. এস. কে. এম এ ভর্তি হলেন প্ৰিয় ছাত্র সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে অনুরোধ করেছিলেন তাঁকে শান্তিনিকেতনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্ত সেইবারে আর তাঁর ফিরে যাওয়া হয়নি।২আগস্ট তিনি চিরশান্তি লাভ করেন।
আজও বিশ্বভারতীর ওই কালোবাড়ির গায়ে খোদাই করা তাঁর ভাস্কর্যগুলোর সামনে দাঁড়ালে সেই কালো নিকষ গাত্রবর্ণের মানুষটির কথা মনে হয়। এক লহমায় যিনি নিখুঁত গড়ে দিতে পারতেন মানুষের অবয়ব, সেই মানুষটির সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যেত এই অলস দুপুরে।যদি তিনি বেরিয়ে আসতেন উত্তরায়ণ থেকে খোলা গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গাইতে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ সূর্যের মত হাসিটি নিয়ে....
অন্তরগ্লানি,সংসারভার
পলক ফেলিতে কোথা একাকার
জীবনের মাঝে স্বরূপ তোমার
রাখিবারে যদি পাই........
Leave Comments