শীর্ষ টাইমস ডেস্ক: কলকাতার খাবারের ইতিহাস দেখতে গেলে, যদি আমরা কিছু দশক আগে ফিরে যাই, তাহলে দেখতে পাবো শহরের বুকে রমরমিয়ে চলছে পাইস হোটেল। ঘরোয়া স্বাদের খাবার, পাত পেড়ে একসাথে খাবার খাওয়া, আর সাথে সকল শ্রেণির মানুষের আনাগোনাই পাইস হোটেলের বৈশিষ্ট্য। আজও পকেটে ১০০ টাকা হাতে থাকলেই পেট পুরে খেয়ে আসা যাবে শহরের নামকরা পাইস হোটেলগুলিতে।
পাইস হোটেল নামটি আমরা শুনে থাকলেও হয়তো আমরা অনেকেই জানি না যে কেন এই নামকরণ? মনে করা হয়, এক সময় এখানে খাবার পাওয়া যেত চার আনা বা এক পাইস মুদ্রার পরিবর্তে। আবার অনেক সময় বলা হয়, এই সমস্ত হোটেলগুলিতে প্রতিটি আইটেমের দাম আলাদা করে গণনা করা হয়, লেবু নুন সমেত। 'পিস বাই পিস' দাম নেওয়া হত বলেও ধারণা যে এইসমস্ত হোটেলের নাম পাইস হোটেল। কলকাতার বুকে জেগে থাকা, এমনই কিছু নামী ও ঐতিহ্যবাহী পাইস হোটেলের খোঁজ থাকলো আজ আমাদের প্রতিবেদনে।
তরুণ নিকেতন হোটেল: লেক মার্কেট চত্বরের পাইস হোটেল কালচারের ধারক ও বাহক হল ১৯১৫ সালে স্থাপিত তরুণ নিকেতন হোটেল। ঈশান চন্দ্র দেবের হাত ধরে এই খাবার দোকানের সূত্রপাত। মজার ব্যাপার, প্রায় ১০০ বছরেও বদলে যায়নি খুব একটা মেনু। উল্লেখযোগ্য, এখানে চিরাচরিত পদ্ধতিতে রাঁধা, বিভিন্ন ডিশে দেওয়া হয় না পেয়াঁজ ও রশুন পর্যন্ত। তবে বর্তমানে, মাছের কালিয়া, ডিমের কারি এবং মাংসের কারিতে ব্যবহৃত হয় এই গুরু পাক উপকরণগুলি। কখনও গেলে অবশ্যই চেখে দেখবেন হাঁসের ডিমের কারি ও মটনের পাতলা ঝোল।
সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম: ধর্মতলার জানবাজার অঞ্চলে, রাণী রাসমণির আদি গৃহের হাঁটা দূরত্বে এই পাইস হোটেলটি স্থাপিত হয়েছিল ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে, জনৈক ক্ষুদিরাম সরকারের হাত ধরে। বিগত কয়েক বছরে সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে, হয়েছে এসি সেকশন, অবশ্য দামের দিক থেকেও একটু উপরের দিকেই। এখানকার বিভিন্ন মাছের ডিশ শহর জুড়ে বিখ্যাত। এখানকার স্পেশালিটি কবিরাজী ঝোল, ঝুড়ি আলুভাজা ও পোস্তর বড়া।
স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল: মানগোবিন্দ পোণ্ডার হাত ধরে এই পাইস হোটেলটির পথ চলা ১৯২৭ সালে। প্রেসিডেন্সি কলেজের পিছনের গলিতে সগর্বে কাটিয়ে দিয়েছে প্রায় ১০০ বছর। কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে হওয়ার সুবাদে, ছাত্র, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, খাদ্যরসিক, বইপ্রেমিক, প্রায় সব ধরণের মানুষেরই এখানে অবাধ আচরণ। বর্তমানে শহরের শ্রেষ্ঠ তিনটি পাইস হোটেলের মধ্যে এটিকে গণ্য করা হয়। কখনও গেলে ট্রাই করতে ভুলবেন না এখানকার তোপসে ফ্রাই, সিঙ্গি মাগুর আর কৈ মাছের ঝোল এবং অবশ্যই চিতল মাছের মুইঠ্যা।
আদর্শ হিন্দু হোটেল: গরিয়াহাটের কাছে, ২১২ রাসবিহারী এভিনিউ-এর উপরে রয়েছে এই পাইস হোটেলটি। বিভূতিভূষণের রচিত বিখ্যাত উপন্যাসের নামে নামাঙ্কিত এই দোকান। দক্ষিণ কলকাতায় বসে উত্তর কলকাতার আমেজ যে কয়টি হাতে গোনা জায়গায় পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে এই পাইস হোটেলটির উজ্জ্বল নিদর্শন। মাটির ভাঁড়ে জল, আর শালপাতার প্লেটে খাওয়ার এই অভ্যেস কিন্তু প্রচন্ড পরিবেশ-বান্ধব একটি ব্যবস্থা। গড়িয়াহাট অঞ্চলে প্রভূত দেশি বিদেশি রেস্টুরেন্টের ভিড়েও কিন্তু আদর্শ হিন্দু হোটেলের খাওয়া সত্যি এক অনন্য স্বাদ। এখানকার সুস্বাদু খাবারের ভিড়ে চেখে দেখতে ভুলবেন না ঘরোয়া ডাল, চিতলের পেটি, পার্শে, ট্যাংরা, পাবদার ঝাল ও কচি পাঁঠার ঝোল।
নামকরা পাইস হোটেলগুলিতে দাম আগের তুলনায় খানিকটা বেড়ে গেলেও তা রেস্তোরাঁর থেকে বেশ কম। কিন্তু ওই একটা ঘরোয়া এবং অতুলনীয় খাবারের স্বাদ একসঙ্গে নিতে আজও মানুষ পাইস হোটেলগুলোতে ভিড় জমাচ্ছে। তাই কালের দৌড়ে এই পাইস হোটেলগুলো মুখথুবড়ে তো পড়েইনি বরং রমরমিয়ে দৌড়াচ্ছে নিজেদের স্বাদ, গুণমান ও ঐতিহ্যকে সঙ্গে করে।
ছবি: সংগৃহীত
Leave Comments