দেবযানী দত্ত : কলকাতার হালকা শীতে মন ভরছে না? নিম্নচাপের ঠেলায় ঠান্ডা যেন আসতে গিয়েও আসছে না! কিন্ত মনটা চাইছে জাকিয়ে শীতের আমেজ নিতে, তাহলে উপায়?
একটা ছোট্ট তিন-চারদিনের ছুটি হাতে থাকলেই ঘুরে আসতে পারেন নর্থ বেঙ্গলের এক দুর্দান্ত অফবিট লোকেশনে। শীর্ষ টাইমস এই অজানা গ্রামের সন্ধানেই বেরিয়ে পড়েছিল কালিম্পঙ-এর অল্পচেনা ডেস্টিনেশন গুলোর উদ্দেশ্যে।
কালিম্পঙ থেকে যে রাস্তাটা রামধুরা, ইচ্ছেগাঁও-র দিকে চলে যায় সেই পথেই আরও কিছুটা এগিয়ে টার্ন নিলাম বাঁ হাতে। এবার শুরু হল অচেনা সেই পথ যেদিকে টুরিস্টের ভিড় নেই, গাড়ির হর্ন নেই, নেই কোনও ট্র্যাফিক জ্যামের সম্ভাবনাও। দুপাশ জুড়ে শুধুই পাহাড় আর জঙ্গলের অদলবদল। হালকা রোদ মাখা সেই পিচ রাস্তায় এক জায়গায় গাড়ি থামলো। এরপর ডানদিকে একটা রাস্তা যে নিচে নেমে গেছে ওই রাস্তায় একটা মিনিট দশেকের হাইক আমাদের পৌঁছে দেবে শীরিষেগাঁও অব্দি। ঐটুকু পথ,কিন্ত হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল,এই পথ শেষ না হলেও বেশই হবে। পথে জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে খানকতক বাড়ি।কোনও বাড়ির সামনে হরেক রঙা ফুল তো কোনও বাড়ির মাচায় ঝুলছে টাটকা স্কোয়াশ, আবার কোথাও রঙিন কাঠের বাড়ির সামনে চাষ হয়েছে মুলো।
এখানে এই নির্জন পাহাড়ি কোনঠাসা এক গ্রামে যে অনেক হোম স্টে থাকবেনেস্ট না এইটাই তো স্বাভাবিক। আমাদের গন্তব্য ছিল নেস্ট অফ হিলস নেচার হোম স্টে। সেই হোমস্টের পরে গ্রামও শেষ আর রাস্তাও শেষ। তারপর শুধুই জঙ্গলের সরু সিঁথির মতো পথ আর বনভূমি। হোমস্টে পৌঁছাতেই সেখানের অতিথি পরায়ণ বাসিন্দাদের আগমনে মন ভরে যেতে বাধ্য হলো। রুমে ঢুকে তো মন খুশ। সুন্দর পরিপাটি লিনেন, তকতকে বিছানা, কার্পেট আর বাথরুম। কমন ব্যালকনিতে রাখা বইয়ের তাক, ইজি চেয়ার, বসে আড্ডা মারার জন্য চৌকি এবং তার ওপরে নরম গদি। আছে হুক্কার ব্যবস্থাও! আর আছে রং বেরঙের জ্যান্ত ফুল। সারা বারান্দাময় তারা যেন খিলখিলিয়ে হাসছে।
পেটে প্রবল খিদে নিয়ে হনহনিয়ে গেলাম কিচেনের দিকে। গরম ভাত, রাই শাক,লোকাল সব অর্গানিক সবজি, ডাল, ভাজা, ডিম দিয়ে কষিয়ে লাঞ্চ করলাম। সাথে উপরি পাওনা ছিল বাম্বু শুটের আচার আর তীব্র ঝাল আর লাল টোপাকুলের মতো দেখতে এক লঙ্কা। সেটাতে শখ করে এক কামড় দিতেই মাড়ির এক দিক যেন অবশ হয়ে এলো। তবে খিদের মুখে এমন সব সুস্বাদু ভোজনে পেট আর মন দুইই ভরে গেল। বিকালে একটু একটু করে প্রকৃতির আলো নিভে যাওয়ার পর, ঠান্ডা আরও বাড়তে লাগলো। শীতল শরীরকে একটু উষ্ণ করে নেওয়ার জন্য বসানো হল ক্যাম্পফায়ারের মজলিস। মাথার ওপরে ঝকঝকে আকাশে জ্বলজ্বলে সব তারা আর রাতচরা পাখির আওয়াজ সঙ্গে আগুন ঘিরে বসে থাকা কয়েকটা মানুষের তাত নেওয়া, সঙ্গে বারবিকিউ চিকেন আর খোশগল্পে সন্ধ্যে কখন যেন পৌঁছে গেল রাতের কোঠায়।
পরদিন ভোরে সাড়ে পাঁচটায় বিছানা ছাড়লাম। এবারেই তো সেই আসল খেলা, যার জন্য এই যাঁকানো শীতেও লেপের ওম ছেড়ে ওঠা! ঘরের ভিতরের কাচের জানালার দিকে চেয়ে বসে রইলাম কম্বল মুড়ি দিয়ে। সেই শুভক্ষণ বুঝি এল বলে। ওই তো আসতে আসতে সকালের সোনালী আভায় ওই যেন কি একটা চকচক করে উঠছে আকাশের গায়ে। একটু একটু করে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সপারিষদ ফুটে উঠলেন কাঞ্চনজঙ্ঘা। সেই রূপ অবর্ণনীয়। ঘরেই চলে এল ভোরের দার্জিলিং চা। চা খেতে খেতে ঘরের ভিতর থেকে বসেই পুরোটা দেখা যাচ্ছিল। কিন্ত এমন রূপ দেখেও কি চুপ করে বসে থাকা যায়। প্রকৃতিকে আরও উপভোগ করতে কাঞ্চনজঙ্ঘা কে পাশে নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম জঙ্গলের রাস্তায়। উদ্দেশ্য জঙ্গলের ভেতরেই একটা স্ট্রবেরি ফার্ম দেখা, আর দেখা একটা সিংকোনা ফার্ম। এই দুটোই ছোট্ট হাইক করে পৌঁছোতে হয়। স্ট্রবেরির জন্য মাটি তৈরী করা ওয়ার্ম, নানান প্রজাতির এলাচ, বাঁশ আরও নানান উপকারী গাছ,নানা পদ্ধতিতে ফলানো সিংকোনা, ল্যাপসি, টক পিয়ারা, হাইব্রিড ফুল, কি না দেখলাম এই ছোট্ট ট্রেইলে।
তবে যাঁরা ভাবেন যে এখানে আরও সাইটসিয়িং করবেন, দু'দিন পাঁচদিন শুধুমাত্র প্রকৃতির নিঝুম কোলে বসে বসে কাটাবেন না তাঁদের জন্যও বহু রাস্তা খোলা। প্রথমত আশেপাশে থাকা বিভিন্ন স্পট যেমন কালিম্পঙ শহর,দারাগাঁও, মানসং, জলসা বাংলো, কাগে, রেশিখোলা, রংপো, ইচ্ছেগাঁও, পেডং ইত্যাদি জায়গা ঘুরে বেড়ানো যায় একইদিনে। দ্বিতীয়ত সিল্ক রুটের এত কাছে হওয়ায় সিলারিগাওঁ এর মতো পপুলেটেড জায়গা বেছে না নিয়ে নির্ভাবনায় বেছে নেওয়াই যায় শীরিষেগাঁওকে। গাড়ি নিয়েও চিন্তার কারণ নেই, সবটাই করে দেবে নেস্ট অফ হিলস নেচার হোমস্টে।
কীভাবে যাবেন : কলকাতা থেকে যে কোনও ট্রেনে /বাসে এনজেপি বা শিলিগুড়ি। তারপর কালিম্পঙ হয়ে সোজা শীরিষেগাঁও। শেয়ারে বা বাসে চাইলে কালিম্পঙ অব্দি চলে যেতেই পারেন, বাকিটা একটা গাড়ি রিজার্ভ করে নিন মোটামুটি ১০০০ টাকার ভিতরে।
যোগাযোগ : Nest of Hills Nature Homestay
Owner কৌশিক পাল : 9830533877
অথবা যোগাযোগ করতে পারেন এই নাম্বারে:
Rittiwik Kumar Mukherjee : 6291319760
Leave Comments