বিশ্বরূপ ঘোষ: ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভারতের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। যে বণিকেরা ব্যবসার মানদন্ড নিয়ে ভারতের বুকে পা রেখেছিল‚ তারাই কালক্রমে শাসনভার হাতে তুলে নেয়। কথিত আছে‚ কলকাতা শহরের পত্তন করেছিলেন এক বণিক জব চার্ণক‚ যদিও মতভেদে অনেকেই মনে করেন এই কাজ করেছে সাবর্ণ পরিবার। বৃটিশদের শাসনকালে কলকাতার নগরায়ণ শুরু হয় এবং পরবর্তীকালে কলকাতা হয়ে যায় রাজধানী। এই সময় অনেকেই নিজেদের ভাগ্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পা রেখেছিলেন এই শহরে। শাসনতন্ত্রের কাঠামো বজায় রাখার জন্য জন হলওয়ে পেশাভিত্তিক অঞ্চল ভাগ করে দেন। এর ফলেই মুচিপাড়া‚ কলুটোলা‚ শুড়িপাড়া‚ ছুতোরপাড়া‚ কুমোরটুলি প্রভৃতি এলাকার উৎপত্তি হয়।
লর্ড ক্লাইভ জোর করে দ্বৈত শাসনব্যবস্থা চালু করলে তার ফল ভালো হয়নি। এর ফলে গোটা বাংলা জুড়ে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। ১৭৭২ সালে এই প্রথার অবসান ঘটিয়ে ফেলা হয়। এরপর রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য লর্ড কর্নওয়ালিস নিয়ে আসেন নতুন এক পন্থা‚ যা পরিচিত ছিল 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত' নামে। এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও বৃটিশদের সঙ্গে ব্যবসা করে একদল লোক প্রচুর অর্থের মালিক হয়ে ওঠে‚ যারা নিজেদের পরিচয় দিত 'বাবু' হিসেবে।কলকাতার নগরায়ণের ফলেই একটু লাভের আশায় নদীয়া‚ মুর্শিদাবাদ‚ কৃষ্ণনগর থেকে কুমোররা চলে আসতে থাকেন কলকাতায়। মাটির বাসনপত্রের পরিবর্তে চাহিদা বাড়তে থাকে কাঁসা পিতলের। এর ফলে সমস্যা তৈরি হলে পুতুল তৈরি করতে থাকেন তাঁরা। সপ্তদশ শতকের একদম শুরুর দিকে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র চালু করেন দুর্গাপূজার। কালক্রমে সেই দুর্গাপূজা হয়ে দাঁড়ায় 'বাবু' সমাজের বৈভব‚ প্রতিপত্তি প্রদর্শনের মাধ্যম। কলকাতায় ধনীর পরিমাণ বাড়তে থাকার ফলে পুজোর পরিমাণও বেড়ে যায় এবং চাহিদা বাড়তে থাকে মৃৎশিল্পীদের। কাজের সুবিধার জন্য জঙ্গল পরিষ্কার করে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন তাঁরা। কুমোরটুলির অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে বারেবারেই। তবে বর্তমানে কুমোরটুলি অঞ্চলটি হল বাগবাজার ও শোভাবাজারের মধ্যবর্তী এলাকায়।
কুমোরটুলিতে পুরুষ শিল্পীরা প্রাধান্যের সঙ্গে কাজ করলেও কোনমতেই পিছিয়ে নেই মহিলা শিল্পীরা। পুরুষদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন রাখালচন্দ্র রুদ্রপাল‚ মোহনবাঁশি রুদ্রপাল‚ সনাতন পাল‚ গোরাচাঁদ পাল যোগেন্দ্র পাল প্রমুখরা। বিশ শতকের একদম শেষ দশকের থেকে প্রতিমা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকেন মহিলারাও। এই বিষয়ে এগিয়ে এসেছিলেন কামাখ্যা পাল‚ মালা পাল ও চায়না পাল। শুরুতে বিভিন্ন কটাক্ষের শিকার হলেও পাত্তা দেননি তাঁরা। তাইতো সফলতার গন্ডি ছুঁতে পেরেছেন। মালা পালকে আহ্বান করেছে দেশি- বিদেশি বিভিন্ন এক্সিবিশন কমিটি। এরপর যুক্ত হন কাকলি মিনতি পাল‚ সোমা পাল সহ আরও অনেকেই। দিনে দিনে কুমোরটুলির সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র দেশ নয় বিদেশেও রপ্তানি করা হয় প্রচুর মূর্তি। কিন্তু এত কিছুর পরও অন্ধকারে সেখানকার শিল্পীরা। কুমোরটুলি অঞ্চলটি রীতিমত সংকীর্ণ। বর্ষার সময় অসুবিধায় পরতে হয় বহু শিল্পীকেই। দুর্গাপূজার সময় লাভের মুখ ভালোভাবে দেখলেও অন্যসময় 'ভাঁড়ে মা ভবাণী'। এর সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে বাঁশ‚ খড় সহ বিভিন্ন উপাদানের খরচ। এইসব কিছুকেই সঙ্গী করেই পূর্বপুরুষদের পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন শিল্পীরা এবং বাঁচিয়ে রেখেছেন বাংলার অন্যতম ঐতিহ্য মৃৎশিল্প।
ছবি সংগৃহীত
Leave Comments