• India
  • Last Update 11.30 am
  • 29℃ Kolkata, India
news-details
Education

আজকের সুলভ বরফই ছিল উপনিবেশিক ভারতের মহার্ঘ্য বস্তু!জানুন বরফ ব্যবসার ইতিহাস

ad

বিশ্বরূপ ঘোষ: একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকে দাঁড়িয়ে দৈনন্দিন জীবনে বরফ একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং সহজলভ্য বটে। নিয়মিত রূপচর্চা  অসুস্থতা কিংবা পানীয়তে হামেশাই ব্যবহার করা হয় বরফ।আজকের দিনে বরফ ঘরে তৈরি করা গেলেও ভিক্টোরিয়ান যুগে তা মোটেই সহজলভ্য ছিল না।সেই সময়ের বরফের মূল্য ছিল দুই আনা প্রতি সের এবং জাহাজে করে আসতে সময় লাগত চার মাসেরও বেশি সময়।তাহলে ধারণা করা যাচ্ছে যে‚ ঠিক কতটা মহার্ঘ বস্তু ছিল এই বরফ‌। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে বরফ আমদানি পিছনে ছিল বেশ  কিছু না জানা ঘটনা।

বরফ ব্যবসার ক্ষেত্রে রীতিমত বিপ্লব এনেছিলেন ফ্রেডরিক টিউডর নামক এক ব্যবসায়ী।সেই জন্য তিনি পরিচিত হয়েছিলেন আইস কিং নামেও।টিউডর বোস্টনের এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের প্রথা অনুযায়ী প্রথমে শুরু করেন বরফের ব্যবসা।সেই ব্যবসায় উল্লেখযোগ্য কিছু না হওয়ায় তা বন্ধ করে দেন।এরপর ফ্রেডরিক মনস্থির করে কফির ব্যবসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেখান থেকেও কোনভাবেই লাভের মুখ দেখতে পাননি‌। বিপুল পরিমাণে ঋণের দায়ে ডুবে গিয়ে জেলে যেতে গিয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন।এইসময় তিনি তাঁর জীবনের সবথেকে বড়ো বাজি খেললেন‚সিদ্ধান্ত নিলেন ব্রিটিশ শাসিত ভারতে বরফের চালান দেবেন। যেমন ভাবা তেমনই কাজ‚ এই বিষয়ে তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন দুই অংশীদার রজার্স ও অস্টিন।১৭৭৮ সাল নাগাদ লর্ড কর্নওয়ালিস বিদেশি বণিকদের ব্যবসার জন্য প্রচুর সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন‚যার মধ্য দিয়েই এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল টিউডর-এর সামনে।

ঊনবিংশ শতকে জাহাজের মাধ্যমে আটালান্টিক মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগর পার করে ভারতে আসতে সময় লাগত প্রায় চার মাসের বেশি সময়।এইসময় ফ্রেডরিকের অন্যতম সহযোগী ওয়াইথ বরফ তৈরির এক নতুন পন্থা আবিস্কার করেন।দুই ব্লেড যুক্ত ঘোড়ায় টানা বরফ কাটা যন্ত্রের দ্বারা বর্গাকারে বরফ‌ কাটার এই পদ্ধতি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।বরফ যাতে সুরক্ষিত থাকে সেই জন্য প্যাকেটিং করা হত।বরফ পরিবহন এ যাতে কোনও সমস্যা না তৈরি হয় সেইজন্য দুই দেওয়াল সহযোগে স্টোর হাউস ছিল।এই স্টোর হাউস- এ চামড়াজাত পণ্য ও করাতের গুঁড়ো ব্যবহার হত।

১৮৩৩ সালের ১২ মে বোস্টন থেকে প্রায় ১৮০ টন বরফ নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয় টাসকানি নামক একটি জাহাজ এবং কলকাতা বন্দরে এসে নোঙর ফেলে ৬ সেপ্টেম্বর‚যদিও তখনও অক্ষত ছিল প্রায় ১০০ টন বরফ।জানা যায় যে‚বরফ দেখতে বন্দরে ভিড় হয়েছিল বিপুল পরিমাণ মানুষের।সেই মানুষদের মধ্যে এক ব্যক্তি দাবি করেছিলেন বরফ-এ হাত দেওয়ার ফলে নাকি পুড়ে গিয়েছিল।

উচ্চ অক্ষাংশ ও আটলান্টিকের পূর্ব তীরে অবস্থিত ম্যাসাচুসেটসেরর মিষ্টি জলের হ্রদগুলোতে প্রচুর পরিমাণে বরফ উৎপন্ন হতো। যেমন ওয়েনহ্যাম লেকের বরফের বিশুদ্ধতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন মাইকেল ফ্যারাডের মতো বিজ্ঞানীরাও। এ বরফ যেত ইংল্যান্ডে। ফ্যারাডে আবিষ্কার করেন, বাতাসের বুদবুদ ও লবণ থাকত বলে এই বরফ দ্রুত গলত না।

ভারতে বরফের বাজার ধরার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা করেন ফ্রেডরিক টিউডর। ভারতের জলবায়ু ক্রান্তীয় প্রকৃতির ফলত বাজার ধরা বেশ কিছুটা সহজ হয়ে যায়। বৃটিশ শাসনের পূর্বেও বরফের চাহিদা ছিল।৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পারস্যের প্রকৌশলীরা যেসব পর্বতে থেকে বরফ কেটে তা সংরক্ষণের কৌশল আবিস্কার করেন। পুরু দেয়ালের কনটেইনারে পুরে এসব বরফগুলো মাটির নিচে রেখে প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষণ করা হতো।মোঘলরা হিমালয় থেকে সরবরাহকৃত বরফ ব্যবহার করতেন।ইংরেজরা এদেশে পর শ্রমিক লাগিয়ে বরফ তৈরির কাজ করাতেন‚যারা পরিচিত ছিলেন 'আবদার' হিসেবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য‚দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি 'হুগলি আইস' স্বাদে ও গুণে আমেরিকান বরফের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে ছিল।ফ্রেডরিক টিউডর প্রথমেই বরফ আমদানি ‌করে চড়া দামে বিক্রি করার কথা ভাবেননি।প্রথমত তিনি সাহেব মেমদের মধ্যে বরফ-এর চাহিদা তৈরি করে দেন। এরপর ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে তৈরি করেন 'আইস হাউস' বা 'বরফ ঘর'।প্রথমে গঙ্গার ধারে, স্ট্র্যান্ডে আর তার পর বর্তমান ব্যাঙ্কশাল কোর্টের ঠিক পশ্চিমে, চার্চ লেনের দিকে মুখ করে।খুব ভোরে অভিজাতরা বাড়ির পরিচারকদের পাঠিয়ে দিতেন 'আইস হাউস'-এ।সেখান থেকে মেপে প্যাকিং করে হাতে তুলে দেওয়া হতো। এক্ষেত্রে প্রচুর কারচুপি হতো। বাড়ির পরিচারকেরা বেশ কিছুটা বরফ বেঁচে দিত এবং দাবি করত বরফ গলে গেছে। তৎকালীন বাজারমূল্যে বরফ বিকোত সের প্রতি দুই আনায়।

কলকাতায় টিউডরের কারবার সামলাতেন উইলিয়াম রজার্স।তিনি সরকারের কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা আদায় করে নেন।এরফলে আমদানি শুল্ক ফাঁকি যেমন দেওয়া গেল‚ তেমনই বরফ নষ্ট হবে এই অজুহাত দেখিয়ে পছন্দমত স্থানে জাহাজ নোঙর করা ও বরফের গুণগতমান পরীক্ষার থেকেও মিলল নিস্কৃতি।তাহলে বোঝাই যাচ্ছে যে‚এই ব্যবসা কতটা লাভজনক ছিল।প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এই ব্যবসায় আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন বহুবার কিন্তু অনুমতি পাননি একবারও।বরফ ব্যবসার লাভবান হয়ে শুধু সেখানেই থেমে থাকেননি ফ্রেডরিক টিউডর‚এছাড়াও আপেল‚আঙুর‚মাখন প্রভৃতি সরবরাহ শুরু করে করেন।টিউডরকে দেখে বোম্বেতে বরফের কারবার শুরু করেন নুসেরভানজি ওয়াদিয়া।ডিনার পার্টিতে আইসক্রিম পাঠানোর দায়িত্ব নেন জামসেদজি জিজিভাই।সেসময় বরফের এতটাই চাহিদা ছিল যার ফলে গ্রান্ট লিখেছিলেন ' ব্যাংক ফেল করলে মানুষ যতটা না উত্তেজিত তার থেকেও বেশি উত্তেজিত বরফ না পেয়ে'।

১৮৬৪ সালে টিউডরের মৃত্যুর পর বরফ ব্যবসার পতন শুরু হতে থাকে এবং এইসময় বরফ তৈরির আধুনিক পদ্ধতিও চলে আসে।প্রচুর পরিমাণে রেলের লাইন বসার ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও দূষণ ক্রমাগত বাড়তে থাকে‚যার ফলে বরফ‌  তৈরি হতে সমস্যা হয়। থরো এক বর্ণনায় বলেন, রেললাইনের জন্য ওয়ালডন পন্ডের আশপাশের অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছিল।বরফের মান কমে যাওয়া, এ অঞ্চলে বরফ তৈরির যন্ত্র আবিস্কারসহ নানা কারণে বরফ ব্যবসা টালমাটাল হয়ে পড়ে।১৮৭৪ সালে মাদ্রাজে কৃত্রিম উপায়ে বরফ তৈরি হয়।১৮৭৮ সালে গড়ে তোলা হয় 'বেঙ্গল আইস'। এরপর গড়ে ওঠে ক্যালকাটা আইস অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেড’। মার্কিন বরফ আমদানির বিদায়ঘণ্টা বেজে গেল। শেষ হল অর্থনৈতিক ইতিহাসের এক ব্যতিক্রমী অধ্যায়।

ছবি সংগৃহীত 

You can share this post!

Leave Comments