দেবযানী দত্ত: মনে করা হয় পারসিয়ান শব্দ 'বিরিনজ' যার অর্থ ভাত, তা থেকেই না কি 'বিরিয়ানি' শব্দের উৎপত্তি। আবার কারও কারও মত, 'বিরিনজ' নয় আদপে পারসি শব্দ 'বিরিয়ান' শব্দ থেকে 'বিরিয়ানি' পদটির নামকরণ। পারস্য দেশের এই খাবার মুঘলদের হাত ধরেই প্রথম উত্তর ভারতে আসে বলে মনে করা হয়। যদিও দক্ষিণ ভারতের গল্প কিছুটা আলাদা। সেখানে নাকি আরবের ব্যবসায়ীদের হাত ধরে প্রবেশ করেছিল বিরিয়ানী। তখন তার নাম ছিল আন সোরু। তবে গোলাপ তো গোলাপই থাকে, তা সে যে বাগানেই ফুটুক না কেন! একসময়ে রাজারাজড়া আর সৈন্যদের খাবার এখনকার জমানায় চলে এসেছে সব্বার হাতের নাগালে। বছর দশেক আগেও কিন্ত বিরিয়ানি মিলত বাছা বাছা কয়েকটা মাত্র রেস্টুরেন্টে। আর আজ পথে ঘাটে, লাল শালু ঢাকা হাঁড়ি আর অপূর্ব গন্ধেই ক্ষিদে পেয়ে যায় আট থেকে আশির।
এ তো গেল বিরিয়ানির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। বিরিয়ানি লাভাররা তো বই ও লিখে ফেলেছেন বিরিয়ানিকে নিয়ে। ইন্ডিয়ার মোস্ট গুগলড ডিশ এই বিরিয়ানির রকমফেরও তো অনেক। যে দেশে মাত্র কয়েকশ কিলোমিটারে বদলে যায় ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সেখানে বিরিয়ানির স্বাদও যে ভিন্ন ভিন্ন হবে তা বলাই বাহুল্য। এখন তো আবার মানুষজন চান বিভিন্ন জায়গার অথেন্টিক ডিশ ট্রাই করতে। তাই বিভিন্ন রাজ্যের বিরিয়ানির একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা রইল।
কলকাতা বিরিয়ানি: ১৮৫৬ সালে আউধের নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ কলকাতা এলে তাঁর সাথে লাখনৌ বিরিয়ানি চলে আসে কলকাতায়। আর তার বাঙালিকরণ হয়ে আলু যোগ হয়। যোগ হয় কাবাবচিনি। চড়া গন্ধের জন্য মিঠা আতর, গোলাপজল। আজকাল ডিমও থাকে বিরিয়ানিতে।
লাখনৌ বিরিয়ানি: লাখনৌ এর রাজদরবারের খানসামারা ছিলেন এক একজন ওস্তাদ। মোতি বিরিয়ানি, দামফুক্ত বিরিয়ানি এগুলো লাখনৌ-এর দান। এই বিরিয়ানি খুব কম মশলায় বানানো হয়। চাল গুলো থাকে ছাড়া ছাড়া। গন্ধ থাকে হালকা। মাংস থাকে বড় সাইজের। মোতি বিরিয়ানি অবশ্য ছোট ছোট মাংসের বল দিয়ে বানানো হয়।
দিল্লি বিরিয়ানি : জামা মসজিদ, নিজামুদ্দিন দরগার আশেপাশে আজও এই দুর্দান্ত স্বাদের বিরিয়ানি পাওয়া যায়। ছোট ছোট মাংসের পিস থাকে একাধিক। কেওড়া জল, জাফরান, মাখন ব্যবহৃত হয়।
মালাবার বিরিয়ানি : এই বিরিয়ানিকে থ্যালাসেরি বিরিয়ানিও বলা হয়। কেরালার মুসলিম সম্প্রদায় এই বিরিয়ানির প্রচলন করেন। খাইমা অথবা জিরাকাসালা এই দুটি চালের যে কোনও একটিই ব্যবহার করা হয় থ্যালাসেরি বিরিয়ানি বানাতে।
হায়দরাবাদী বিরিয়ানি: তুলসীমালা চাল দিয়ে তৈরি বিরিয়ানি। তিনটি স্তরে বিরিয়ানি সজ্জিত হয়। একদম নীচের স্তরটি সবথেকে বেশি মশলাদার হয়।
ভাটকালি বিরিয়ানি: কোস্টাল কর্ণাটকের বিরিয়ানি যেখানে কারীপাতা ব্যবহার হয় না।
কাশ্মীরি বিরিয়ানি: বাসমতি চালে তৈরি, ড্রাইফ্রুট আর খাসির মাংসের বিরিয়ানি।
তেহরি : পোলাও চালে তৈরি। নিরামিষও রান্না করা যায়। মাংসও দেওয়া যায়। মাংসের পিসগুলো ছোট ছোট হয় কিউবের আকারে। এক রঙের বিরিয়ানি। উত্তর ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানে বেশ বিখ্যাত।
ডিন্ডিগুল বিরিয়ানি: তামিলনাড়ুর ডিন্ডিগুল অঞ্চলের বিরিয়ানি। ছোট ছোট আকৃতির চাল যার নাম সিরাগা সাম্বা, তা ব্যবহার হয় এই বিরিয়ানিতে। এই চালের নিজস্ব কোনও স্বাদ না থাকায় অত্যধিক মশলাদার এই বিরিয়ানির সব মশলাই দুর্দান্ত খাপ খেয়ে যায় এই চালে, ফলে তৈরি হয় এক অনবদ্য ডিশ। দই আর লেবু দিয়ে বানানো হয় এই পদ।
বোম্বে বিরিয়ানি: শুধুমাত্র কলকাতা বিরিয়ানিতে আলু থাকে ভাবলে ভুল করবেন। বিরিয়ানিতে আলু দেন মারাঠিরাও। সে ভেজ হোক বা নন-ভেজ।
সিন্ধি বিরিয়ানি: সবথেকে মশলাদার বিরিয়ানিগুলোর একটি। যাতে আলুও থাকে, আলুবোখড়া ও থাকে।
মেমনি বিরিয়ানি: গুজরাট, সিন্ধ, কছ অঞ্চলের বিরিয়ানি।সাদা চাল, হলুদ চাল, লাল চাল একসাথে ডিশটিকে দেখতে লাগে রঙিন ও মনোহর।
ভেজ বিরিয়ানি: এই বিরিয়ানিকে আদৌ বিরিয়ানি বলা হবে না পোলাও এই নিয়েই এখনও তর্ক চলছে পাড়ার চায়ের দোকান থেকে শুরু করে ডিজিটাল মাধ্যম অবদি।এই সমস্যার সমাধান না হওয়া অবদি ভেজ বিরিয়ানি নিয়ে না লেখাই ভালো।
এখানেই শেষ নয়। ভারতে বিরিয়ানির প্রকারভেদের 'পিকচার অভি বাকি হ্যায়'। তবে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আরও কয়েকটি ভারতীয় বিরিয়ানির নাম উল্লেখ করা যেতেই পারে। যেমন, অম্বুর বিরিয়ানি, আসামিস বিরিয়ানি, কোঝি (কালিকট) বিরিয়ানি, চেট্টিনাড় বিরিয়ানি, কালিয়ানি বিরিয়ানি, অঙ্গারা বিরিয়ানি, কোত্তিনাড় বিরিয়ানি, ইয়াখনী বিরিয়ানি, পর্দা বিরিয়ানি।
এছাড়া ভারতের বাইরের কিছু বিরিয়ানি, চিনিগুড়া চালের বাংলাদেশি বিরিয়ানি, বেরেস্তা ছড়ানো ঢাকাই বিরিয়ানি, করাচি বিরিয়ানি, পাকিস্তানের বিখ্যাত স্টুডেন্ট বিরিয়ানি, শ্রীলংকান বিরিয়ানি, ইন্দোনেশিয়ার নাসি কাবুলি, বর্মার বিরিয়ানি, ইত্যাদি।
বিরিয়ানি প্রেমীরা রোববার দিনে একটা লিস্ট বানিয়ে পথে নেমে পড়ুন কোমর বেঁধে। ওপরের বিরিয়ানিগুলোর মধ্যে অন্তত দশটা বিরিয়ানির খোঁজ পেয়ে যাবেন খাবারের শহর কলকাতাতেই
Leave Comments