দেবযানী দত্ত: বিংশ শতাব্দীর গোড়ার কথা। তখন বাংলা সাময়িক পত্র অর্থাৎ বাংলা ম্যাগাজিনের স্বর্ণযুগ।একের পর এক সাময়িক পত্রিকা বেরোচ্ছে, তাতে লিখছেন রীতিমত নামজাদা কবি-সাহিত্যিক থেকে শুরু করে সদ্য লেখালেখি শুরু করা অনামী লেখক, প্রত্যেকেই। প্রবাসী, ভারতবর্ষ,সবুজপত্র, কল্লোল,কালি-কলম, মোসলেম ভারত,বিজলী, বেণু, শিখা, ধূমকেতু,অবতার, আরও কত পত্রিকাই না তখন প্রচলিত নাম ছিল ঘরে ঘরে। প্রকাশক সংস্থা আলাদা আলাদা হলেও এই সব পত্রিকাগুলির একটা অন্যতম প্রধান যোগসূত্র ছিল যে এই সমস্ত পত্রিকাই কোনও না কোনওভাবে রবীন্দ্রনাথের লেখা সমৃদ্ধ ছিল অথবা তাঁর আশীর্বাদ ধন্য ছিল। অন্ততপক্ষে তাঁর একটি সম্পাদকীয় বা ভূমিকা লেখনী থাকত এগুলিতে। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল একটি সাময়িকীই। সেটিই হল 'নারায়ণ'। এমনকি সে যুগের বাকি বাংলা ম্যাগাজিনের মতো নামকরণও করা হয়নি এটির।
ঠিক যে বছর রবীন্দ্র বন্ধু প্রমথ চৌধুরী তাঁর 'সবুজপত্র' বের করলেন বেছে বেছে ঠিক সেই বছরে অর্থাৎ ১৯১৪ সালের অগ্রহায়ণ মাসেই কেন 'নারায়ণ'-এর আত্মপ্রকাশ হল সে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। তাও আবার সম্পাদক যেখানে চিত্তরঞ্জন দাশ এবং এ কাজে তাঁর সহকারী তাঁরই গুরু বিপিনচন্দ্র পাল। এই দুই ব্যক্তির রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ সর্বজনপরিচিত। এমনকি জোড়াসাঁকোর 'খামখেয়ালী' সভায় নিত্য আসা যাওয়াও ছিল চিত্তরঞ্জনের। অবশ্য তখনও তিনি 'দেশবন্ধু' হন নি। তাঁর আইন ব্যবসার পাশাপাশি তিনি সাহিত্য অনুরাগী বরাবরই ছিলেন। ১৯১৩ তেই তো লিখেছিলেন 'সাগর-সঙ্গীত', যা তাঁকে খ্যাতি এনে দেয় সাহিত্য জগতে।
কিন্ত সব সরিয়ে রেখে কিছু মানুষ প্রশ্ন তো করেছেন এবং এখনও করেন যে ঠিক 'সবুজপত্র' প্রকাশের বছরেই 'নারায়ণ'-এর আগমন কি নেহাৎই কাকতালীয়?
রবীন্দ্রনাথের একটি লেখাও কখনও 'নারায়ণ' এ প্রকাশিত হয় নি। উল্টে অনেকেই মনে করেন 'সবুজপত্র'-এর প্রথম সংখ্যায় বেরোনো রবীন্দ্রনাথের 'স্ত্রী'র পত্র' গল্পটির প্রত্যুত্তর গল্প হিসাবে লেখা হয় 'মৃণালের চিঠি'।
হিন্দু ধর্মের বিরোধিতা করে একসময় বিপিনচন্দ্র পাল গ্রহণ করেছিলেন ব্রাহ্ম ধর্ম। কিন্ত পরে হয়ত কোথাও তাঁর কোনও অনুশোচনা থেকেই গিয়েছিল,এমন কথা বহু ঐতিহাসিকই বলে থাকেন। এর ফলে 'নারায়ণ' পত্রিকার হিন্দুত্ববাদী ভাবধারাকে তিনি সমর্থন করেছিলেন। শুধুই সমর্থন বললে ভুল হবে, তিনিই ছিলেন 'নারায়ণ'-এর পালক পিতা। চিত্তরঞ্জন যখন আইনের কাজে ও দেশীয় রাজনীতিতে ব্যস্ত তখন 'নারায়ণ'-কে ধরে দু'হাতে রেখেছিলেন বিপিনচন্দ্রই। 'নারায়ণ'এর ২০৮/২ কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের অফিসে লেখা পাঠাতেন বহু প্রথিতযশা লেখক থেকে নব্যলেখক সবাই। ৯ বছর চলার পর স্তব্ধ হয়ে যায় 'নারায়ণ'। রেখে যায় বহু কৃতী সাহিত্যসৃষ্টি এবং একইসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রনাথ, রামমোহন রায় ও ব্রাহ্ম ধর্ম ও সমাজের বিরোধিতা করার জন্যই সৃষ্টি হওয়ার বিতর্ক।
ছবি : সংগৃহীত।
Leave Comments