দেবযানী দত্ত : বিষে বিষে বিষক্ষয় যদি সম্ভব হয়, নিজেরা ভূত সেজে ভূত তাড়ানো সম্ভব হবে না কেন? আর ঠিক এই বিশ্বাস থেকেই বহু বহু বছর ধরে প্রতি বছরের ৩১ অক্টোবর পালিত হয়ে আসছে হ্যালোউইন, একসময়ের একটা রিচুয়াল বা ধর্মীয় রীতি যা এখন পরিণত হয়েছে একটা উৎসবে। ছোটবেলায় হলিউড সিনেমায় দেখেছি সাহেবদের দেশের জলজ্যান্ত মানুষেরা এইদিনে ছেঁড়া,ফাটা জামাকাপড় পড়ে, মুখে চুন কালি মেখে ভূত পেত্নী সেজে পার্টি করে। আমাদের উৎসবে তো সাধারণত আমরা সবথেকে সুন্দর সাজতে চাই,কিন্ত এ কেমন উৎসব যেখানে খারাপ ভূতের মতো দেখতে সাজতে চাওয়াটাই রীতি! আসলে এই উৎসব কিন্ত দু হাজারের বছরের বেশি পুরানো। আসুন একটু ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরাই।
আয়ারল্যান্ড আর স্কটল্যান্ডের সেই সময়কার পৌত্তলিক সেল্টিক মতাবলম্বী লোকেরা ফসল কাটার মরসুমের একদম শেষ দিনটায় একসাথে এক জায়গায় জড়ো হতো। আগুন জ্বালিয়ে সবাই হাতে হাত ধরে দাঁড়াত তার চারপাশে। শামহেইন নামের সেই কাল্ট প্র্যাকটিস চলত ভূত তাড়ানোর জন্য। কারণ তারা বিশ্বাস করত যে এই রাতেই আমাদের ইহলোক আর তেনাদের মানে প্রেতাত্মাদের পরলোকের মধ্যে দূরত্ব এতই কমে যায় যে ভূত প্রেত যখন তখন এসে পৌঁছে যায় মানুষের মধ্যে।
আয়ারল্যান্ড থেকে মানুষ যখন আমেরিকা এলো, সঙ্গে করে নিয়ে এলো এই রীতিও।এই ধর্মীয় রীতিতে আসতে আসতে পরিবর্তন এলো। এবার এর নাম হলো all saints day (অল সেইন্ট'স ডে ) নামে। সেই দিন থাকতো ১নভেম্বর। মনে করা হত যত স্বর্গগত ক্রিশ্চিয়ান সাধুরা রয়েছেন তাঁদের আত্মারা এই সময় পৃথিবীতে নেমে আসেন। পড়ে যখন দেখা গেলো শামহেইন আর অল সেইন্ট'স ডে মূল বিষয়ের মধ্যে তেমন কোনও ফারাক নেই, তখন থেকেই দুটো দিনকে মিলিয়ে শুরু করা হলো হলোমাস তারপর হ্যালোউইন। আর এই ধর্মীয় রীতিই ক্রমে পরিণত হলো উৎসবে।
আমেরিকায় তো একটা সময়ে হলোউইনে মানুষের বাচ্চাদের এমন দৌরাত্ম শুরু হলো যে সে বলার কথা নয়। ভূতেও অমন শয়তানি করতে পারবে কি না সন্দেহ। ভূতের কস্টিউম পড়ে দুষ্টু বাচ্চারা পাড়ার রাতের বেলা বাড়ি বাড়ি গিয়ে দরজায় কড়া নেড়ে জানতে চাইত 'ট্রিক অর ট্রিট?' যদি কেউ 'ট্রিট'-এ ক্যান্ডি দিত তো ঠিক আছে, যদি বলত 'ট্রিক', অমনি বাচ্চাদের দল সেই বাড়ির বেড়া ভেঙে, বাগান নষ্ট করে, বাড়ি পুরো তছনছ করে পালাত!
এছাড়া এদিন প্রত্যেক বাড়ির সামনে সন্ধ্যের অন্ধকার দূর করার জন্য ইয়াব্বড় বড় সাইজের কুমড়োকে কেটে ভূতের মুখ বানিয়ে তার মধ্যে মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়।
কি এসব শুনে কি কোথাও আমাদের ভূত চতুর্দশীর কথা মনে পড়ছে না? মনে পড়াটাই তো স্বাভাবিক। কারণ আমাদের মধ্যে এই প্রাচীন বিশ্বাস রয়েছে যে কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ওই দিন পৃথিবীতে নেমে আসে পরলোকের অতৃপ্ত আত্মারা। তাই তো আমরা দোরের সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে সেই অমানিশা দূর করি।
হ্যালোউইন প্রসঙ্গ আসবে আর হলিউডের হ্যালোউইন স্পেশাল সিনেমাগুলোর কথা আসবে না সে কি হয়? ঐসব দেশে প্রতি বছর এই ছুটির সময়ে এরকম সিনেমা মুক্তি পাবেই পাবে এমনই নিয়ম। এরকম কয়েকটা নাম যেগুলো ভারতেও খুব পছন্দ করা হয়েছে সেগুলো উল্লেখ করার চেষ্টা করলাম, সর্বপ্রথমে যেটা না বললেই নয় সেই ১৯৭৮ এর সিনেমা 'হ্যালোউইন' এর কথাই বলবো। এই সিনেমা তৎকালীন সময়ে এমনই ক্রেজ তৈরী করে যে প্রতি বছরই এর সিকুয়েল বেরোতে থাকে। ২০২২ এ 'হ্যালোউইন এন্ডস' এখনও পর্যন্ত এই সিরিজের শেষ ছবি। সেদেশে মুখোশ পড়া সাইকো খুনিদের হাতে একের পর এক মানুষের নৃশংস খুন হয়ে যাওয়া নিয়ে সিনেমা জনরা বেশ জনপ্রিয়। যদিও দেশ কাল নির্বিশেষে এই ধরণের নৃশংস, হিংস্র সিনেমার একটা নির্দিষ্ট অডিয়েন্স সবসময়ই রয়েছে। পার্ল, দা পার্জ, চেইন স ম্যাসাকার, এক্স, ইনফিনিটি পুল, দা উইচ, স্ক্রিম ইত্যাদি এই ধরনের স্ল্যাশার সিনেমার ছোট্ট একটা তালিকা যা সাধারণত হ্যালোউইনে দেখাটাই বেশি প্রচলিত।
তবে হাল ফ্যাশন মেনে কিন্ত নব্যবঙ্গের লোকজনও হ্যালোউইন পালন করছে আজকাল। নিউ মার্কেটের অলি গলি তে বিক্রি হচ্ছে ভুতুড়ে মাস্ক, কঙ্কাল ড্রেস,অদ্ভুত সব দানবের সাজপোশাক। লোকজন এখানেও করছে হ্যালোউইন পার্টি। সবমিলিয়ে আমাদের দেশের কার্তিকের হালকা শীতের আমেজে ব্যাপারখানা বেশ জমজমাট বলা যেতেই পারে।
ছবি ও তথ্য : সংগৃহীত
Leave Comments