দেবযানী দত্ত : মুখার্জি বাড়ির একমাত্র পুত্র সুবিমল আগে নিজে এক গ্লাস জল গড়িয়েও খেতেন না। চাকুরীরতা বৌ নির্মলা বিয়ের পর প্রথম প্রথম তাঁকে অনেক বুঝিয়েছেন,ঘরের কাজকর্ম না হোক অন্ততঃ রাতের রান্নাটুকুর দায়িত্বও যদি সুবিমল নেয়,তাহলে সংসারে খানিক স্বস্তি আসে। কিন্ত সুবিমল ছোট থেকেই মা ঠাকুমার আদরে অভ্যস্ত। কোনও দিন এক কাপ চা বানিয়ে খেতে হয় নি তাঁকে নিজে হাতে। নিত্যদিনের ঘরোয়া সমস্ত কাজ একজন স্ত্রী এসে একজন পুরুষের জন্য সারাজীবন করে যাবেন এমনটাই ধারণা ছিল গত শতাব্দীর শেষের দিকেও। কিন্ত সেই সুবিমল নির্মলার ছেলে প্রীতম যখন বড় হল,সে বেছে নিল কাতারের পাঁচতারা এক হোটেলে চিফ শেফের মস্ত জব । উঁহু,প্রীতমের এই রান্নার শখ কিন্ত হঠাৎ গজায় নি। বরং নির্মলা তাকে ছোট থেকেই শিখিয়েছেন, রান্না বিষয়টায় ছেলে মেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা নিয়ম লাগু হয় না। অন্ততঃ আজকের যুগে যখন মেয়েরাও সমান তালে বাইরের কাজ, অফিস কাছারি, ব্যবসা সবই করছে যখন তাই ঘরের কাজটা ও আজ শুধু মেয়েদের নয়,রান্নাটা তো নয়ই।
আজ 'বিশ্ব মেন মেক ডিনার দিবস' (Men make dinner day)! অর্থাৎ আজ কি না পুরুষদের বাড়ির জন্য দিনের প্রধান রান্নাটি করার প্রতীকী দিন। আগুন আবিষ্কার হওয়ার পরে মানুষ কাঁচা মাংস খাওয়া ছেড়ে রান্না করতে তো শিখল,কিন্ত কখন থেকে যে এটা নেহাৎ মেয়েলি কাজ হয়ে উঠল কোনও প্রাগঐতিহাসিক নথি তার প্রমাণ রাখার জন্য নেই। কিন্ত এই যুগেও যদি সেই প্রস্তর যুগের মনোভাব থেকে যায় তাহলে মানুষের সভ্যতা এগিয়ে যাওয়ার গল্পটাও তো আলোনা থেকে যায়, তাই না? আসলে এই দিবস টিবস পালন তো একটা দিনের গল্প হতে পারে না। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন বহু পুরুষই স্ত্রী-দের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে রান্নাঘরের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। বহু ছেলে তার সাবলম্বী মায়ের কাছ থেকে শিখছে ছোট ছোট রান্না করার পদ্ধতিগুলো। কর্মক্ষেত্রে একলা থাকা বহু পুরুষ হোটেলে খেয়ে পেট খারাপ অসুখ বাঁধানোর ভয়ে নিজেই হাত-পা নেড়ে বানিয়ে ফেলছেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘরোয়া পদ। কারও কারও বয়স্ক বাবা জ্যাঠাদের দেখি বাড়িতে আত্মীয় সমাগমের দিনে ফাটিয়ে পোলাও-মাংস রাঁধতে।
যৌথ পরিবারে বড় হওয়া,ডিম সেদ্ধ করতেও নারাজ মৃণাল বাবুকে নিয়ে সারাজীবন হিমশিম খেতে হয়েছে মা এবং স্ত্রী শাশ্বতীকে। মৃণাল সবসময়েই বলে গিয়েছেন, 'পুরুষ মানুষ হয়ে কি চুড়ি পড়ে রান্নাঘরে ঢুকতে হবে না কি শেষকালে?' মা ও স্ত্রী একে একে গত হওয়ার পরে বিগতযৌবন মৃণাল ভাবেন যদি রান্নাটা শিখে নিতেন, এভাবে নাকানিচোবানি খেতে হত না। কাজের লোকের নিত্যদিন কামাই, মুখে তোলা যায় না এমন রান্না খেতে খেতে তিনি বুঝেছেন, ক্ষিদে নারী পুরুষ দেখে না, অতএব রান্নাটা লাক্সারি নয়, দিনশেষে নেসেসিটি।
আজ মৃণালবাবু, ছেলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার অভি আর তার স্ত্রী বিদিশা আর ছোট্ট নাতনি তিয়া একই বাড়িতে থাকেন। নাতনি তিয়া যখন বিদিশার গর্ভে তখন বাবা হতে চলা অভি দীর্ঘ আট মাস নিজে রান্না করেছে। এমনকি বাইরের রান্না আনহাইজেনিক হতে পারে ভেবে গর্ভবতী বৌয়ের যখন যা খেতে ইচ্ছে গেছে, রান্না করে খাইয়েছে, রান্নার বই দেখে দেখে। ছেলেটা এতটাই যত্নে রেখেছে যে মেয়েটাকে প্রথম গর্ভধারণেও যেতে হয় নি নিজের মায়ের বাড়ি। ছেলের এমন কান্ড বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখেছেন মৃণাল। মনে মনে ধন্যবাদ দিয়েছেন মুক্তমনা স্বর্গগতা মা মণিবালাকেও , তাঁর দৌলতেই তো নাতির এই রান্না শেখা, বুঝতে শেখা রান্না কোনও মেয়েলি কাজ নয় বরং একটা সারভাইভাল টেকনিক মাত্র!
ছবি :সংগৃহীত।
Leave Comments