• India
  • Last Update 11.30 am
  • 29℃ Kolkata, India
news-details
Entertainment

ভাঙ্গা-র 'অ্যানিম্যাল'-এর কেন এত মিল কিংবদন্তী 'গডফাদার'-এর সঙ্গে? কিছু দৃশ্য সত্যিই কি সেই কথা বলে না?

ad

নীলাঞ্জন রায় চৌধুরী : "ইতিহাস হামকো শিখায়া হ্যায় কি কিসিকোভি মারা যা সকতা হ্যায়। " গদফাদার ২ এর শেষের দিকে মাইকেল করলেওনি টম হেগেলকে বলেছিলেন এই একই ডায়লগ! জামাইদের কে পরিবারের অংশ না ভাবাটাও ওই সিনেমার বৈশিষ্ট্য ছিল, গডফাদার ছবির শেষে যখন মাইকেল তার বোন কনির বরকে মেরে ফেলে পরিবারের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার কারণে, (যেটা অ্যানিমেল সিনেমাতেও ঘটেছে যখন রনবিজয় অর্থাৎ অ্যানিমেল তার বড়দিদির বরকে মেরে ফেলে কারণটা একই ) সেই খবরটা বোনকে জানানোর ধরণটাও অবিশ্বাস্য ভাবে একই রকমের।

 

পয়লা ডিসেম্বর মুক্তি পেয়েছে সন্দীপ রেড্ডি ভাঙ্গার 'অ্যানিম্যাল'।এই ছবির ব্যাপারে বহু সমালোচনা হল, বহুজন বহু দৃষ্টিকোণ থেকে সিনেমাটাকে জাজ করলেও একটা রীতিমতো চোখে লাগা বিষয়ে বড় একটা কথা বলতে কাউকেই দেখা গেল না। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই লক্ষণীয় ব্যাপারটার নাম দিলাম 'গডফাদার সিনড্রোম'। বলিউডে বিভিন্ন সিনেমাতে হলিউডের অথবা বিদেশী প্ৰখ্যাত বা অখ্যাত সিনেমার কনসেপ্ট অথবা ডায়লগ ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং এখনো হয়। এমন প্রচুর উদাহরণ আছে, যা বিদেশী সিনেমার ধারণা নিয়েই তৈরী হয়েছে। যেমন আব্বাস মাস্তানের প্রায় সব সিনেমাই। মহেশ ভাট নিজে পরিচালনা ছাড়ার পরে " বিশেষ " ব্যানারের বেশিরভাগ ছবিই বিদেশী প্রায় অখ্যাত সিনেমার কপিসমূহ। হলে হলিউডের একটি কিংবদন্তী ছবিকে অনুসরণ করে আমির খান করেছেন" লাল সিং চাড্ডা "। কিন্ত ক্রেডিটে বেমালুম চেপে গিয়ে 'অ্যানিম্যাল' ছবিতে 'গডফাদার'এবং 'গডফাদার ২ ' দুটো কিংবদন্তী সিনেম থেকে বেশ কিছু দৃশ্য ডায়লগ এভাবে ঝেঁপে দেবেন ভাঙ্গা অথচ সবাই এদিক থেকে নজর সরিয়ে রেখে শুধুমাত্র আলফা রণবীরের টক্সিসিটি নিয়েই কথা বলবে, আর এই সুযোগে দুর্বল প্লটের একটা সিনেমা কোটি কোটি কামাবে এটাই হয়ত চেয়েছিলেন ভাঙ্গা আর তাঁর পি আর টিম।

 

এ বছরের অর্ধেক পেরিয়ে যাওয়ার পরে অ্যানিমেলের টিজার বেরোলো। এরপরে বেশ কয়েকবার ট্রেলার দেখলাম। পয়লা ডিসেম্বর রিলিজের পরে ফেসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়াতে অ্যানিমেল দেখতে এড়িয়ে যেতাম যাতে স্পয়লার চোখে না পড়ে। তাও স্পয়েল হয়ে গেল, কারণ কানে আসলো অ্যানিমেল টক্সিক ছবি, এতে কী না করা হয়েছে মহিলাদের সাথে! কেউ কেউ বলেই ফেললেন সন্দীপ রেড্ডি ভাঙ্গা একটা প্রায় সাইকো! ওর সিনেমা ছেড়ে সাইকোলজিস্ট এর কাছে যাওয়া কর্তব্য। এসব শুনে একটু দ্বিধা করেই সিনেমা হলে গেলাম 'অ্যানিম্যাল' দেখতে। দেখার পরে প্রথম প্রতিক্রিয়া এই ছিল,সোশ্যাল মিডিয়া যেমন মুক্তির প্রথমদিন থেকেই লিখছে যে এই সিনেমাতে অত্যাধিক ভায়োলেন্স আছে, মেয়েদের পণ্যের মত ব্যবহার করা হয়েছে, এইসব বোধহয় কোথাও প্রচারের অঙ্গ নয়ত একপ্রকার স্মৃতিভ্রম। কেন স্মৃতিভ্রম? কারণ পরিমাণ টক্সিসিটি দেখানো হয়েছে এই ছবিতে, সেরকমই বা হয়ত তার থেকেও বেশি, অনেক বেশি টক্সিক সিনেমা বলিউডে হয়েছে, এবং সেইগুলো কখনও প্রকট ছিল অথবা কখনো প্রচ্ছন্ন ছিল। কিন্ত যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়া কিছু বলে নি তাই সেইসব সিনেমাগুলো বিনা বাক্যব্যায়েই উৎরে গিয়েছিল।

 

 এবার আসি সিনেমার অন্যান্য দিকগুলোতে।প্রথমেই প্রশংসা করবো এই ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের। হর্ষবর্ধন রামেশ্বরের রক্তগরম করে দেওয়ার মত বিজিএম আছে বিশেষ করে যেখানেই নাটকীয় মুহূর্ত তৈরী করার মত পরিস্থিতি এসেছে।

 

অ্যাকশন ড্রামা হিসাবে এই সিনেমার কোরিওগ্রাফি বেশ ভালো। কিন্তু অ্যাকশনের এক্সিকিউশনে খামতি রয়েছে।কোথাও কোথাও মনে হয়েছে এক্সিকিউশন টা কৃত্রিম। তবে বাকি বলিউড সিনেমায় অ্যাকশনের গড় মান দেখলে এই ছবির অ্যাকশন উন্নতমানের, কিন্তু কোরিয়ান, ইউরোপিয়ান অথবা হলিউডের কাছে কিছুটা ম্রিয়মান। এখানে বাজেটের সমস্যা বলে আমার মনে হয়নি। শুটিং দৃশ্যগুলো আরো বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে রক্তপাতটা দেখাতে হত। তবে বছর জুড়ে অ্যাকশনধর্মী সিনেমা গুলোয় অত্যধিক স্লো মোশন আর সোয়াগ দেখে দেখে যাঁরা ক্লান্ত তাদের এই স্মার্ট অ্যাকশন মুভস গুলো স্বস্তি দেবে।

 

আগেই বলেছি,ছবির চিত্রনাট্য দুর্বল, কারণ বুননটা ঠিক জমেনি বলে মনে হয়েছে কিন্তু ডায়লগ অনেক ক্ষেত্রেই বেশ ভালো। চিত্রনাট্য ভালো হলে ৩ ঘন্টা ২১ মিনিটের লম্বা ছবির প্রথমার্ধেই উশখুসানি শুরু হওয়ার কথা নয়। যেটা এই সিনেমায় অনেক দর্শকের মধ্যেই লক্ষ্য করা গেল।শুনলাম ভাঙ্গা সাহেব সিনেমার দৈর্ঘ্য যাতে সাড়ে তিন ঘন্টাই থাকে তার জন্য সেন্সর বোর্ডের সাথে বিরাট যুঝেছেন। কিন্তু এই যুদ্ধের ফলটা ঠিক পাওয়া হল না, কারণ ছবিটি প্রথমার্ধেই খেই হারিয়ে ফেললো। অবিশ্বাস্য লম্বা প্রথমার্ধের শেষে মনে হল যে সিনেমাটা এখানেই শেষ হলে ভালো হত, দ্বিতীয়ার্ধের কীই বা দরকার! মনেই পড়ে নি যে ট্রেলারে ববি দেওল ছিলেন। এরপরে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে ববি দেওলকে দেখে আবার আশা জাগলো। এরথেকেই বোঝা যাচ্ছে ববি দেওল সিনেমায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর এন্ট্রি দৃশ্যটি হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে সেরা এন্ট্রিগুলোর মধ্যে ঠাঁই পাবে নিশ্চিত।

 


এই ছবির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল বাবা ছেলের সম্পর্ক। সাধারণত বাবার সাথে ছেলের সম্পর্কের উত্তরণ হয় বয়সের সাথে সাথে সাথে। এই সিনেমায় ব্যতিক্রম। এখানে দেখানো হয়েছে ছেলের এবং বাবার সম্পর্ক দশ বছরে যা ছিল, ছত্রিশেও তাই আছে। এটা ছেলের যেমন বাবার প্রতি তেমন বাবারও ছেলের প্রতি। ছেলের বাবার প্রতি এই অবসেশন বাবার ছেলেকে সময় না দেওয়ায় তৈরী হয়েছে। খুব কম বয়সেই তৈরী হয়েছে, মাঝে বিভিন্ন ঘটনার তারতম্য এটাকে টলাতে পারেনি। 

 


ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে এই যে প্লটের খুঁত, অ্যাকশনের খুঁত, অযথা টেনে নিয়ে চলা সিন্, অযথা ডায়লগবাজি, আরো ইত্যাদি সব কিছুকেই ছাপিয়ে গেছে এখানে রণবীর কাপুরের অভিনয়। যা এই ছবির মূল বিষয়বস্তুকে অনেকটা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পেরেছে। রণবীরকে বিভিন্ন বয়সে ভালোই মানিয়েছে। বিশেষ করে বড় চুলের লুকস'টা সত্যিই ছবির কম্পোজিশনকে সফলতা দিয়েছে। এই সিনেমায় রণবীরের চোখের ভাষার পরিবর্তন, শরীরিক গঠনের পরিবর্তন এতটাই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে যে তা অবশ্যই একজন অভিনেতার ডেডিকেশনের ফসল এবং তা চোখেও পড়ে। ছবির প্রকৃত অসফলতাকে তিনি তার শিল্পসুষমায় ঢেকে দিয়েছেন।

 


এই ছবির অ্যালবাম মনে রাখার মত, কয়েকটা গান সত্যিই শ্রুতিমধুর। ইরানি,পাঞ্জাবী ফোকের ব্যবহার যথপোযুক্ত। ছবিতে 'পেহলি দফা' গানটি যে সময়ে ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা যথাযথ হতে পারত যদি গল্পে রনবীরের সাথে রশ্মিকার দাম্পত্য সম্পর্কে অন্যরকম মোচড় থাকত। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই অসাধারণ গান এবং বিশাল মিশ্রর আকুতিপূর্ণ মেলোডিসম্পন্ন গলাও প্লটের দুর্বলতার কারণে আমাদের হৃদয়কে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায়! ছোঁয় না।

 

প্রাইভেট জেটে রমণের স্বাদ ছবির জুটি নিয়েছেন এবং আমরা দেখেই আঁশ মিটিয়েছি। যদিও সিনেমার কিছু বোল্ড সিন্ আমার আরোপিত মনে হয়েছে, এর কোনো প্রয়োজন ছিল না।  হটাৎ করেই বিন্দুমাত্র পূর্বাভাস ছাড়া একটা অবৈধ পড়া, অযাচিত শরীরিক সম্পর্কের দৃশ্য, যেন কিছু একটা  ছকভাঙা করে ঝুলে যাওয়া দ্বিতীয়ার্ধকে উজ্জীবিত রাখার চেষ্টা বলে মনে হয়েছে।বোধহয় দর্শক টানার জন্যই দেখানো হয়েছে। ছবিতে এসবের কিছু বিরাট গুরুত্ব ছিল বলে তো মনে হয় না! তবে কিছু দর্শক আলফা রণবীরের বাকি সমস্ত আলফাগিরির থেকে তাঁর পরকীয়ার স্বাদ যে বেশি নিয়েছেন তা ওই মাখোমাখো দৃশ্য গুলিতে সিটি হাততালি পড়াতে, উল্লাস প্রকাশেই স্পষ্ট।

 

 সিনেমায় বহু দৃশ্য থেকেই বহুবার এই ছবির সিকুয়েলের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে। সিনেমাটি যেভাবে শুরু বা শেষ হয়েছে সেটিকেও যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ লেগেছে।

 

শেষ কিছু কথায় একটা ছোট্ট ত্রিভিয়া, অভিনেতা অনিল কাপুরের বুকের লোম দেখা যায়নি, কারণ উনি কামিয়ে ফেলেছেন। এ নিয়ে ছবিতেও একটা দৃশ্যও রাখা হয়েছে যেটি বেশ উপভোগ্য।
রশ্মিকার কাছে যেটুকু চাওয়া হয়েছিল, সেটা রশ্মিকা দিতে পেরেছেন। অনেকদিন পরে প্রেম চোপড়াকে দেখে ভালো লেগেছে, শক্তিকাপুর একটি ছোট্ট রোল করেছেন, তবে যিনি অল্প রোল পেয়েও নিজের লুক এবং চোখের অভিব্যক্তি দিয়ে সবার দৃষ্টি ছিনিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেছেন, তিনি হলেন ববি দেওল। এনার বলিউডে কামব্যাক নিয়ে একদিন গাথা রচিত হবে।
ভুল সিদ্ধান্ত,চরিত্রের টক্সিসিটি, বদরাগ, এবং হঠকারিতা একজন রক্ষাকারী মানুষকেও যে কতটা একা করে তোলে এ সিনেমা যেন তার আখ্যান। এই সিনেমাতে কোথাও আলফা মেল হতে বলা হয়নি, বরং আলফা মেল যদি সত্যিই থাকে তবে তার মধ্যে বিটা, গামা, ডেল্টা, সিগমা সবই থাকবে, কারণ শুধু আলফা সমাজে বাঁচতে পারে না, একা হয়ে যায়, এবং যাদেরকে সে তথাকথিত দুর্বল মনে করতো তারা দিনের শেষে আলফাকে ছেড়ে জীবনের রাস্তায় সহজে এগিয়ে যায়, সফলতা ও প্রতিষ্ঠা পায়, এবং আলফা কিছু ভালো কাজ করেও পরিবর্তিত জগতে স্থবির মানসিকতা নিয়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় কারণ তার পরিবর্তন হয়নি। সন্দীপ রেড্ডি ভাঙ্গার এই হিন্দি সিনেমা তার দ্বিতীয় প্রচেষ্টা, এর আগে তাঁর 'কবীর সিং' কেও লোকে কম টক্সিক বলে নি। সেখানেও এসব প্রচারের সুযোগে চরম ব্যবসা করেছিল সেই ছবি। তিনি ব্যবসা আগেও দিয়েছেন, এখনও দিচ্ছেন, আশা করি তবে এরপরের সিনেমায় নতুন কিছু কনসেপ্ট নিয়ে তিনি আসবেন। ভারতীয় জনগণের মানসিকতা তিনি খুবই ভালো বোঝেন। তাঁর কেরিয়ারগ্রাফ তিনি কিছু সিনেমাটিক মাইলস্টোন দিয়ে না ভরাতে পারলেও দর্শকের পকেট থেকে সিনেমা হলের টিকিটের টাকা বের করে এনে বক্স পরবর্তীকালেও অফিস ভরাতে পারবেন 'অ্যানিম্যাল' দেখার পর তেমন মনে করা যেতেই পারে।


ছবি: সংগৃহীত

You can share this post!

Leave Comments