নীলাঞ্জন রায়চৌধুরী : সম্প্রতি বিশাল বিতর্ক ছড়িয়েছে 'বড়া বিজনেস'-এর ভিভেক বিন্দ্রার বিরুদ্ধে মোটিভেশনাল স্পিকার সন্দীপ মাহেশ্বরীর আনা অভিযোগে। সেখানেই উঠে আসছে কিছু নতুন শব্দ। তার মধ্যে একটি হল পিরামিড স্ক্যাম বা এমএলএম স্ক্যাম। কিন্ত কীভাবে এইসব স্ক্যামের মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছে মানুষ?! কাদের টার্গেট করছে এইসব প্রতারকরা? ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখবেন, যাদেরকে এরা টার্গেট করে তারা বেশিরভাগই বেকার অথবা আর্থিক অবস্থা খারাপ। অনেক স্বপ্ন এবং আশা নিয়ে, ততোধিক কষ্ট করে তারা কোর্স ফি জোগাড় করে এবং কোর্সটা নেয় যাতে তাঁদের জীবন বদলে যায়। এর ফলাফল যে ভালো হয় না তা বলা বাহুল্য। এই স্ক্যামটা বিশ্বব্যাপী। বিশ্বের সেইসব দেশকেই আজকাল বেশি টার্গেট করা হচ্ছে যেখানে গরীবের সংখ্যা বেশি। তাঁদের অসহায়তার সুযোগ নিয়েই এরা ফুলে ফেঁপে উঠছে।
ধরুন একটা কোম্পানি ছাতা বিক্রি করে এমনটা শোনা যায়। যদিও কেউ কোনোদিন ওই কোম্পানির ছাতা দেখেনি, অতএব, ব্যবহার করার প্রশ্নও নেই। কিন্তু যদি আপনি ধরেও নেন যে এই কোম্পানিটা নতুন, তাই এর পণ্য এখনো মানুষের হাতে সেভাবে পৌঁছয়নি। হঠাৎই একদিন জানতে পারলেন সেই কোম্পানি ছাতা তৈরী করার সাথে সাথে কিভাবে ছাতা তৈরী করে বড়োলোক হওয়া যায় সেটা শেখানোর জন্য একটা ফ্রিতে তিনদিনের সেমিনারের আয়োজন করেছে। অন্তর্জালের কল্যানে ইউ টিউবে তাদের ভিডিও দেখে আপনি হতবম্ব হয়ে গেছেন, কারণ আপনি দেখছেন সেই কোম্পানির সি ই ও এর কাছে কি নেই!খানকতক মার্সিডিজ গাড়ি, এছাড়া বি এম ডাবলু, ফিয়াট,হয়ত রোলস রয়েসও পেয়ে যেতে পারেন। সাথে সাথেই দেখবেন লোকটি তার বিশাল ম্যানশনের সাথে আপনার পরিচয় করাচ্ছে বা হয়ত কোন বিলাসবহুল রেস্তোরাঁর সুইমিং পুলের সেডানে বসে ডাব খাচ্ছে। সে যাই করুক না কেন দেখবেন পুরোটা সময় ভিডিওতে আপনাকে কিছু কথা বলতে থাকবে। কথাগুলো মোটামুটি এরকম : ১) আজ থেকে কয়েক বছর আগে সে আপনার মতোই বেকার ছিল বা, অথবা হাড়মাস এক করে ৯ টা ৫ টার শিফট করতো। ২) হঠাৎই এক বিজনেস গুরুর কোর্স নিয়ে তার জীবন বদলে গেল। ৩) এরপরে রাতারাতি খুব সময়ে সে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেল। ৪) আপনি যদি রাতারাতি কোটিপতি হতে চান তাহলে এই ফ্রি ওয়েবিনারে যোগ দিন বা তার নিজস্ব ওয়েবসাইটে গিয়ে ৩০ মিনিটের ভিডিও দেখুন। যা আপনার জীবন বদলে দিতে পারে। এতোসব কথা শুনে আপনি উদ্বুদ্ধ হয়ে যদি ওয়েবসাইটে চলে যান, ওই আধঘন্টার ভিডিওতে আপনাকে ব্যবসার কয়েকটি গোড়ার কথা খুব সহজ ভাষায় বলার সাথে সাথে তাদের কোর্স সাবস্ক্রাইব করতে বলা হবে, যা বিরাট ছাড় দিয়ে নূন্যতম মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে, আসন সংখ্যা সীমিত, সুযোগের সদব্যবহার করাটা বুদ্ধিমানের লক্ষণ কারণ সুযোগ বার বার আসে না, আপনার স্বপ্ন সফল হতে আর মাত্র কয়েকটা টাকার তফাৎ, ইত্যাদি। এরপরে আপনি যদি সাহস করে কোর্সটা নিয়ে নেন দেখবেন প্রথম প্রথম বিজনেস নিয়ে দার্শনিক কথা বার্তা বলা হচ্ছে এবং এই কোর্সের থেকে আপনি কি কি শিখবেন তার মহড়া দেওয়া হচ্ছে। যত সময় যাবে আপনি দেখবেন যে যা যা শেখানোর কথা ছিল তার মধ্যে অনেক জিনিসই বাদ চলে যাচ্ছে, এবং বিজনেস করতে শেখানো কোর্সের মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে একেবারেই অন্য কিছু। দেখবেন আপনাকেই বলা হচ্ছে কোর্স বেঁচতে! হ্যাঁ এটাই সত্যি! এতদিন যে কোর্স আপনি করলেন সেটাই এবার আপনি বেঁচবেন।যে ফাইন্যান্সয়াল ফ্রিডমের কথা আপনি উঠতে বসতে শুনতেন সেটা এখন আপনি লোকজনকে শেখাবেন, এবং তাদেরকে কোর্স নিতে বাধ্য করবেন। তাহলে এই ব্যবসার প্রোডাক্ট কি? কেন! এই যে স্কিমটা শুনলেন, এটাই প্রোডাক্ট। এই ধরণের স্কিমের আরেক নাম হল পিরামিড স্কিম।এতে আপনার কি লাভ! আপনার লাভ একটাই, যত বেশি লগ্নি আনতে পারবেন সেটাই আপনার লাভ, এবং কোম্পানিরও লাভ। এই কোম্পানির লাভ দাঁড়িয়ে আছে কতজন এই ব্যবসায়ী বা সফল হওয়ার কোর্স নিচ্ছে তার উপরে। যাঁরা সফল হতে আসবেন তারা কোর্স করার পরে আরো লোকজনদের কাছে তাদের সফল হওয়ার গল্প শোনাবেন। সেই গল্প শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে যদি আরো মানুষ টাকা খরচ করে কোর্স নেয় তাহলে আরো লগ্নি। এই ভাবেই আরো মানুষ, আরো লগ্নি আরো মানুষ আরো লগ্নির খেলা হল পিরামিড স্কিম যাকে সরকার বেআইনি ঘোষণা করেছে ২০২১ সালে। এবং যারাই এই পিরামিড স্কিম বা স্ক্যাম করবেন তাঁদের থেকে শতহস্ত দূরে থাকার জন্য কয়েকটি সাধারণ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শগুলো হল, ১) কোম্পানি যা যা দাবী করছে যে সেগুলো তারা ভবিষ্যতে করবে, সেগুলো যদি তারা না করতে পারে তাহলে সেটা আইনত অপরাধ। তাই কোম্পানির মুখপাত্র মুখে যা বলছেন, চুক্তিপত্রে যেন সেটাই লেখা থাকে, এটা দেখে নেওয়া অবশ্য কর্তব্য। যদি মুখের কথা বা চুক্তিপত্রের কথা না মেলে তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে কোম্পানি স্ক্যাম করবে।২) প্রোডাক্ট কি সেটা পরিষ্কারভাবে জানা। তার দাম কি, বাকি কোম্পানিদের দামের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলা হচ্ছে কিনা। কোম্পানির যদি প্রোডাক্ট না থাকে তাহলে খুব সম্ভবত সেটা স্ক্যাম।
ছবি : ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।
Leave Comments