নীলাঞ্জন রায়চৌধুরী : কিছুদিন আগে একবার কি একটা কারণে হাতিবাগানের দিকে গিয়েছিলাম। উত্তর কলকাতায় চোরাগলির অভাব নেই, এমনই একটা চোরাগলি দিয়ে ঢুকে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই দেখি গোয়াবাগানে পৌঁছে গেছি। জায়গার নামটা চেনা চেনা লাগলো, তারপরেই মনে পড়লো! এখানেই তো কিংবদন্তী বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বাড়ি। বাড়িটা আশেপাশেই আছে সেটা জানি! কিন্তু, সন্ধ্যে নেমেছে। আর আমিও হালকা রাতকানা, মানে সন্ধ্যাবেলা গলি চিনতে ভুল করি, তাই বিপদে পড়ে ভাবলাম কাউকে জিজ্ঞেস করি! চারপাশে তাকিয়ে যাদেরকে দেখছিলাম তারা অধিকাংশই অবাঙালি অথবা বাচ্চা বা বড়জোর কিশোর। এবং এক বাঙালি কিশোর আজকে সত্যেন বোসকে একডাকে চিনবে কিনা, সেই ব্যাপারে ঠিক ভরসা পেলাম না! আমার সাথে যিনি ছিলেন তিনি বললেন যে এখানে জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ হবে না মনে হয়। কারোর বয়সও এতো বেশি নয় যে সত্যেন বোসের জীবদ্দশায় জন্মেছেন বলে জানবেন তাঁর কথা। চারপাশে তাকালাম নিদেনপক্ষে একজন রিকশাওলা পাওয়া গেলেও তিনি তাঁর পেশার কারণে হয়ত জানবেন! কিন্তু তেমন কাউকে পেলাম না। অগত্যা এক ভদ্রলোককে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "এখানে সত্যেন বোসের বাড়িটা কোথায় বলতে পারবেন?" শোনা যায় প্রফেসর বোস তাঁর আগাগোড়া জীবনে বেজায় পপুলার মানুষ ছিলেন। সারা ভারতজোড়া তাঁর ভক্তকুল ছিল, কলকাতার মানুষ এক ডাকে তাঁকে চিনতো! মনে খুব একটা আশা ছিল না যে এই বছর পঞ্চাশের অবাঙালি লোকটার থেকে কোনো সদুত্তর পাবো! প্রশ্নটি শুনে লোকটি আমার মুখের দিকে তাকালেন! এরপর হঠাৎই কোনো কথা না বলে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং পরিষ্কার বাংলায় বললেন সত্যেন বোস মানে জাতীয় অধ্যাপক সত্যেন বোসের বাড়ি যেতে চাইছেন তো! এই রাস্তা দিয়ে সোজা গিয়ে একটা গলি ছেড়ে বামদিকে ঢুকে যে বাড়িতে ধাক্কা খাচ্ছেন তার পাশের বাড়িটা। সত্যিই সত্যেন বোস এখনো পপুলার। গত ১ লা জানুয়ারি তাঁর জন্মের ১৩০ তম বর্ষপূর্তির দিনেও তিনি কলকাতার হৃদয়ে যথাযতভাবেই আছেন।সত্যেন বোসের কিংবদন্তী সম্পর্কে মানুষের আজকাল বেশ অবহিত হওয়াই স্বাভাবিক। তাঁর জীবনের অসাধারণ সব ঘটনা আজকে অগুনতি বই এবং সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে মানুষের আর অজানা থাকার কথা নয়। আজকে আমরা তাঁর সম্পর্কে কিছু স্বল্প আলোচিত বা অলক্ষ্যে থাকা ঘটনা জেনে নেবো।
১) সত্যেন বোস হিন্দু স্কুলে পড়াকালীন তিনি অঙ্কে ১০০ তে ১১০ পেয়েছিলেন এটা আমরা সকলেই জানি। যে শিক্ষক তাঁকে এই নম্বর দেন, তাঁর নাম উপেন বক্সী। তৎকালীন হেডমাস্টার রসময়বাবু এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন " কি করব ও যা উত্তর লিখেছে তার পক্ষে ১০০ নম্বর যথেষ্ট হয় না। কাজেই তার চেয়ে বেশি দিতে বাধ্য হয়েছি। "
২) সত্যেন বোসের কথাবার্তায় ভালোরকম "ইয়ে" শব্দটির ব্যবহার ছিল। ঠিক মুদ্রা দোষের পর্যায় নয়, কিন্তু কথায় কথায় "ইয়ে" বলতেন।
৩) সত্যেন বোসের ছোটবেলার স্কুলে মুকুন্দলাল ঘোষ নামে একটি ছেলে ছিল যাকে তিনি "পেকুলিয়ার" ছেলে বলতেন। সেই ছেলেটির একটি অদ্ভুত এক ক্ষমতা ছিল - সে জিভ উল্টে গলার ভিতরের দিকে ঢুকিয়ে দিতে পারতো। সেই ছেলেটি স্কুলে এসব কীর্তিকলাপ করতো। পরে সে আমেরিকায় যায় এবং যোগানন্দ পরমহংস নামে জগৎবিখ্যাত হয়। যার "অটোবায়োগ্রাফি অব আ যোগী" একটি জগৎবিখ্যাত বেস্টসেলার।
৪)আইনস্টাইনের সঙ্গে প্রফেসর বোসের পত্র বিনিময় কিংবা বোস আইনস্টাইন সংখ্যায়ন আজকে সর্বজনবিদিত। কিন্তু কজন জানেন পদার্থবিদ্যা ছাড়াও রসায়নশাস্ত্রের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক পদে থাকাকালীন অধ্যাপক বসু একটি সুপরিকল্পিত রসায়নাগার গড়ে তোলেন। এই সময় তিনি কয়েকজন রসায়নবিজ্ঞানীর সহায়তায় আন্টিবায়োটিক্স এবং নানা ওষুধ যেমন সালফা ড্রাগ এবং প্যাটুলিন জাতীয় পাইরোন যৌগ সংশ্লেষণে মনোনিবেশ করেন। এছাড়া এক্স রে ক্রিস্টালোগ্রাফির সাহায্যে বিভিন্ন জৈব যৌগের গঠনরীতি জানবার বিষয়ে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
৫) প্রফেসর বোস একবার জার্মানির গোটিংয়েনে প্রফেসর অটো হানের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। এই হানই সেই বিজ্ঞানী যিনি পরীক্ষাগারে প্রমান করেছিলেন যে পরমাণুর হৃদয় বিদীর্ণ করে যে শক্তি পাওয়া যায় সেটি আইনস্টাইনের ভর-শক্তি তুল্যতা নীতির সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়। এই কাজের জন্য হান নোবেল পুরস্কার পান, এবং পুরস্কারটি পেয়ে বৃদ্ধ বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ককে দেখাতে যান। তাঁদের দুইজনের একটি স্থিরচিত্র তোলা হয়। প্রফেসর বোস এই ছবিটি নেবার জন্য জোরাজুরি শুরু করেন। হানও নাছোড়বান্দা, কিছুতেই ছবি দেবেন না। অবশেষে একটি কপি পাওয়া যায় এবং প্রফেসর বোস সেটি নিয়ে সন্তুষ্ট হন।
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।
Leave Comments