• India
  • Last Update 11.30 am
  • 29℃ Kolkata, India
news-details
Entertainment

দেব কি 'দেবতা' হতে গিয়েই স্বর্গচ্যুত হয়ে পড়লেন? কেমন হল 'প্রধান'

ad

নীলাঞ্জন রায়চৌধুরী : একদিকে পঞ্চায়েত প্রধান একদিকে দীপক প্রধান, কিন্তু ধরমপুরে প্রধান একজনই! চেনা যাচ্ছে কিছু! মনিরত্নম পরিচালিত গুরু সিনেমাতে এমনই কথাবার্তা হয়েছিল গুরুভাই এবং দি ইনডিপেনডেন্ট সংবাদপত্রের সম্পাদক মানিক দাসগুপ্তর মধ্যে। সেই আইকনিক মুহূর্তের যে ধক ছিল সেটা প্রধানের মধ্যে ঠিক পাওয়া গেল না। গতকাল অভিজিৎ সেনের পরিচালিত প্রধান সিনেমাটা দেখতে গেলাম। মূল ভূমিকায় ছিলেন দেব, পরান বন্দোপাধ্যায় এবং অনির্বান চক্রবর্তী। দেব একজন সৎ পুলিশ অফিসার যার বদলি হয় ধরমপুরে। ধরমপুরে ত্রাসের আরেক নাম পঞ্চায়েত প্রধান জটিলশ্বর মুখার্জি, যার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন একেনবাবু খ্যাত অনির্বান চক্রবর্তী। ধরমপুরে ১৫ বছর ভোট না হওয়ার এই রীতিকে পাল্টাতেই দীপক প্রধান অর্থাৎ দেবের পঞ্চায়েত প্রধানের মুখোমুখি হওয়া, এবং মাস্টারমশাই অর্থাৎ পরান বন্দোপাধ্যায়ের ভোটে দাঁড়ানো এই ছবির মুখ্য বিষয়। গুরুত্বপূর্ন পার্শ্বচরিত্রে যাঁরা অভিনয় করেছেন তাঁদের মধ্যে, অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইন্সপেক্টরের ভূমিকায় সোহম এবং সুজননীল, এছাড়াও আছেন খরাজ, কাঞ্চন, অম্বরীশ, মমতাশংঙ্কর, সৌমিতৃষা, কনীনিকা ইত্যাদি। তাহলে চলুন জেনে নিই প্রধান সিনেমার ভালো এবং খারাপ দিক।

ভালো :

সিনেমার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। বাংলা সিনেমা অরাজনৈতিক হয়ে উঠছে এমন অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। সেটা অনেক অংশে সত্যিও। শেষ চার পাঁচ বছরে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলা ছবি হয়েছে হাতে গোনা। চা বাগান ঘেরা পাহাড়ি গ্রামে এক নেতার ট্যাক্সের টাকায় কারচুপি, মিড ডে মিল কেলেঙ্কারি, সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা, সাধারণ মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি, এই সবই সিনেমার বিষয়বস্তু হলেও সবকটিই আজকে সমাজের বাস্তবতার কথা বলে।আমাদের সমাজে ঘটে চলা একের পর এক কেলেঙ্কারি, প্রতারণা এবং তার সঙ্গে অনবরত যুঝে চলা সমস্যাক্লিষ্ট সাধারণ মানুষের জীবনকে এই ছবির মূল বিষয়বস্তু করায় পরিচালককে কুর্নিশ জানাতেই হচ্ছে।

অনির্বান চক্রবর্তীর অভিনয় : সাম্প্রতিক কালে বাংলা সিনেমার সবচেয়ে ভার্সেটাইল অভিনেতাদের মধ্যে একজন তিনি যে কোনো চরিত্রেই তিনি সমানরকম সাবলীল। এই ছবিতে পঞ্চায়েত প্রধানের চরিত্রে তিনি কতটা সফল হয়েছেন সেটা এই সিনেমার ক্লাইম্যাক্স সিনে বোঝা গেছে। জটিলশ্বরের পরাজয়ে দর্শকদের আনন্দই বলে দেয় তিনি সফল।

 

দীপকের সাথে অনির্বানের রসায়ন

এই জুটি যতবার পর্দায় এসেছে ততবারই ছবি গতি পেয়েছে। তাদের ডুয়েলটা হয়ে গেছে ভালো বনাম খারাপের , সত্য বনাম মিথ্যার, পসিটিভ বনাম নেগেটিভের ডুয়েল। ডুয়েলের সময় বি জি এম একটা সিন্ বাদে বেশ ভালো।

দেবের সুপারম্যান না হয়ে ওঠাও এই সিনেমার প্লাস পয়েন্ট। দেবের পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার করে ধুমধারাক্কা তাকে দিয়ে মারপিট করিয়ে বিষয়টাকে অবাস্তব করে তোলেননি পরিচালক।

এই সিনেমাতে ভোটের দ্বারা নেতা নির্বাচন প্রক্রিয়াটা দর্শককে সিটে ধরে রাখতে যথেষ্ট। বিশেষ করে ভোটগণনার দীর্ঘ দৃশ্য, তার পরতে পরতে মোচড়, খল, কুটিল রাজনীতি, ব্যালট পেপার গিলে নেওয়া, কাউন্টিং অফিসার দের ইচ্ছেমত কারচুপি, সিনেমার দ্বিতীয়ার্ধকে অন্য মাত্রা দেয়। প্রায় আড়াই ঘন্টার গোটা সিনেমাটির মধ্যে এইটাই ছবির হাই পয়েন্ট, এই সময়ে গোটা সিনেমাহলে পিনড্রপ সাইলেন্স ছিল! 

খারাপ দিক :

স্ক্রিনরাইটিং বেশ দুর্বল, কমিক পাঞ্চলাইনগুলো সবকটা হিট করছে না, অনেকগুলোই হিট অ্যান্ড মিস হয়েছে।

মেলোড্রামার মনোপলি : বাংলা সিনেমার টার্গেট দর্শক গত দশ বছরে যথেষ্ট বদলেছে। আগে যখন চ্যালেঞ্জ বা পাগলুর মত সিনেমা হত তখন সিনেমাগুলো বানানো হত কিশোর, কিশোরী, বা যুবাবয়সের কথা মাথায় রেখে। এখন বাংলা সিনেমা বানানো হয় পঞ্চাশর্ধ মানুষের কথা মাথায় রেখে। প্রথম প্রথম ভালো লাগলেও এখন জিনিসটা কর্কট রোগের মত হয়ে গেছে। একই রকম প্লট ও স্ক্রিনরাইটিং আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেখে যাচ্ছি, যেখানে বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা একা থাকে, একমাত্র ছেলে মা বাবার কথা ভাবে না। মাথার উপর দেনার বোঝা, ছেলে বাড়িতে থাকলে সংসারে অশান্তি! এই সিনেমায় পরান বন্দোপাধ্যায়ের চরিত্র যা মাস্টারমশাই হিসেবে পরিচিত তার সাথে ছেলের বয়সের তফাৎ এতোই বেশি যে ছেলেকে পরানের নাতি মনে হচ্ছিলো।

 

দেবের প্রত্যেকটি ছবিতে দেবতা হওয়ার অবসেশন :

দেবের পর পর ৯ টি ছবি বক্সঅফিসে হিট করেছে, মাঝে শুধু কাছের মানুষ গড়পড়তা ফল করেছে, বাকি হয় সুপারহিট নয়তো ব্লকবাস্টার। প্রধান ইতিমধ্যেই ৬.৫ কোটি কামিয়ে ফেলেছে, হয়তো ৯ থেকে ১০ কোটিতে গিয়ে শেষ করবে! কিন্তু দেবের এতো সফলতার মধ্যে যে প্রবৃত্তি বিষের মত কাজ করছে সেটা হল দেবের পর্দায় গুড ম্যান ইমেজ তৈরী করার আপ্রাণ চেষ্টা। সিনেমা বদলে যায়, দেবের চেষ্টাটা বদলায় না। সাঁঝবাতি থেকে শুরু করে প্রধান অব্দি এই চেষ্টা বহাল আছে। সিনেমার বৃদ্ধ, বৃদ্ধা দর্শকের কাছে দেব হয়ে উঠেছেন তাঁদের আদর্শ সন্তান, কিন্তু এটাই যদি চলতে থাকে তাহলে দেব যাদের জন্য দেব হয়েছেন সেই যুবাদের খুব শীঘ্রই হারাবেন! সিনেমা হলে গিয়ে দেখা যায় বাংলা ছবি দেখতে যাঁরা আসেন তাঁদের বেশিরভাগের বয়স পঞ্চাশের বেশি, এতে খারাপ কিছু নেই, কিন্তু শুধু ব্যবসা করছে বলে এটাই যদি চলতে থাকে, সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন এই মডেল মুখ থুবড়ে পড়বে। বিশ্বাস করুন দেব, যেটা দেখার জন্য দর্শক অধীর চিত্তে অপেক্ষা করছে সেটা হল আপনি আপনার গুড ম্যান ইমেজ ছেড়ে বেরিয়ে আসুন, প্রত্যেক সিনেমায় আপনার কথামৃত, অর্থাৎ জীবনে ভালো মানুষ হওয়া জরুরি, সৎ পথে চলা অবশ্য কর্তব্য, মানুষের সেবাই পরম ধর্ম, এগুলো ছেড়ে বেরিয়ে আসুন। অনেক করেছেন আপনাকে আর মানাচ্ছে না। আপনার চরিত্রে মানুষ শেডস দেখতে চাইছে! আপনার রাফ ব্যবহারেও সিটি বাজাতে চাইছে!

 

বাকি খরাজ, কাঞ্চন, অম্বরীশ, যেমন করেন তেমনই করেছেন, সৌমিতৃষার সুগার ক্যান্ডি হওয়া ছাড়া আলাদা কোনো ভূমিকা ছিল না, আর মমতাশংকরকে দেখলে ইদানিং খারাপ লাগে। কি প্রোফাইল আর কি করছেন আপাতত। সোহিনীর মত প্রতিভাশালী অভিনেত্রীর এরকম রোলে কাস্টিং দেখলে অবাক লাগে।পরান বন্দোপাধ্যায় ভালোই অভিনয় করেছেন। ওনার মাস্টারমশাই চরিত্রে একটা ক্রাইসিস আছে, যেটা উনি যতটা সম্ভব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।

সর্বোপরি মেকিং আরও স্মার্ট হতে পারতো। বি জি এম অনেক ক্ষেত্রে ছবিতে গ্রিপ আনতে পারতো। দেবের সাথে অনির্বান বাদে কারোরই রসায়ন ঠিক জমেনি। ফার্স্টহাফের তুলনায় সেকেন্ডহাফটা বেশ টানটান, এবং সেকেন্ডহাফে একটা গুরুত্বপূর্ণ টুইস্ট আছে যেটার জন্য এই সিনেমাটা যথেষ্ট মাইলেজ পেয়েছে। হয়ত এই টুইস্টটা না থাকলে সিনেমাটা দর্শকের মনে দাগ কাটতে পারতো না।

ছবি : ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।

You can share this post!

Leave Comments