• India
  • Last Update 11.30 am
  • 29℃ Kolkata, India
news-details
Education

বিধানচন্দ্র রায় ও কিছু অজানা কথা

ad

বিশ্বরূপ ঘোষ: পরিবার ছিল চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য এর অনুরাগী‚ তাই "নববিধান" অনুসারে নাম রাখা হয়েছিল বিধানচন্দ্র রায়।ছোটবেলায় আদর করে ঠাকুমা ডাকতেন ভজন বলে।অনেকেই জানেন না ডক্টর বিধান চন্দ্র রায় এম বি পরীক্ষায় একবার ফেল করেছিলেন।সালটা তখন উনিশশো চার কি পাঁচ‚মেডিকেল কলেজ এর গেটের বাইরে দাড়িয়ে ছিলেন বিধানচন্দ্র রায়।ঠিক সেইসময় ঘোড়ার গাড়িতে করে আসছিলেন কর্নেল পেক্ ও তাঁর কোচম্যান।উল্টো দিক থেকে আসা একটি ট্রাম এর সাথে সংঘর্ষ হয় তাঁদের ফলত গাড়িসহ উল্টে যান পেক্ ও তাঁর গাড়িচালক।যদিও দু'জনে অক্ষতই ছিলেন।তখন গাড়ি থেকে নেমে বিধানচন্দ্র  রায় কে ডেকে‌ বললেন তুমি আদালত এ আমার হয়ে সাক্ষ্য দেবে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ট্রামচালক।বিধানচন্দ্র রায় সাক্ষী হতে অস্বীকার পেক্ এর মুখের উপর জাবাব দেন যে ট্রামের গতি ৩০মাইল এর কম ছিল এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী আপনার চালক।পেক্ এক সামান্য নেটিভ ছাত্রের এই অপমান ভোলেননি।এর কিছুদিন পরই ছিল এম বি পরীক্ষা। পরীক্ষার ভার পেক্ এর উপর পড়লে তিনি আর পাশ করাননি বিধানচন্দ্র রায় কে।ফলত মোহভঙ্গ হয় ইংরেজদের প্রতি।নিজেকে সাহেব প্রমাণ করার জন্য নিজের যে নামকরণ করেছিলেন বেঞ্জামিন চার্লস রয় তা বর্জন করেন এই ঘটনার পর থেকেই।

 

লন্ডন থেকে সদ্য পাশ করে এসেছেন এমআরসিপি এবং এফআরসিএস।হাতে সম্বল মাত্র পঁচিশ টাকা।হ্যারিসন রোডে বাড়ি ভাড়া করে নিলেন বলাবাহুল্য পসার তেমন জমেনি‚পকেটে টান পড়তেই শহর কলকাতার বুকেই করেছেন ট্যাক্সি ড্রাইভারি।আবার অনেক সময় দৈনিক আটটাকা ফিস্ এ সেবা করেছেন "মেল নার্স"হিসাবেও।চিকিৎসক হিসাবে অসহায় গরীবদের পুওর বক্স এর মাধ্যমে এবং অনেক সময় অপেক্ষাকৃত কম ফিস্ এ চিকিৎসা করলেও বড়োলোকদের থেকে টাকা নিতে কোনরকম কার্পণ্য করতেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাত্মা গান্ধী‚জহরলাল নেহেরু‚মতিলাল নেহেরু‚ইন্দিরা গান্ধী‚জন এফ কেনেডি‚ক্লিমেন্ট এটলি প্রমুখরা চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ নিতেন বিধান রায়ের।সি আর দাশের সংস্পর্শে আসার পর সাক্ষাৎ পান গান্ধীজীর।যদিও পরবর্তীতে তাঁরা একে অপরের খুব কাছে এসেছিলেন।গান্ধিজী তখন পুণের আগা খাঁ প্যালেসে বন্দী থাকাকালীন অসুস্থ হয়ে পড়লে বিধান রায় তাঁকে দেখতে আসেন এবং ওষুধ খেতে অনুরোধ করেন।তখন গান্ধীজি জবাব দিলেন তুমি যখন সমগ্র ভারতবাসীর চিকিৎসা করতে পারো না তখন আমি তোমার চিকিৎসা নেব না।বিধান রায় উত্তর দিলেন সমগ্র ভারতবাসীর আশার প্রতীক আপনি আর তাঁরা আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছে। গান্ধীজি তখন শিশুর মতো নাছোড়বান্দা হয়ে বললেন আমি এলোপ্যাথি চিকিৎসা নেব না।বিধান বাবু বিন্দুমাত্র অপ্রস্তুত না হয়ে বলেন আপনি তো সবাইকে শিখিয়েছেন এই পৃথিবীর সবকিছুই তো ঈশ্বরের নির্দেশে চলে এলোপ্যাথি চিকিৎসা তো তার বাইরে নয়।শোনা যায় এরপর গান্ধীজি বাধ্য ছেলের মতোই মেনে নেন সব।

 

১৯২২ সালে সরাসরি জাতীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন বিধান রায়।নির্দল প্রার্থী হিসাবে লড়েছিলেন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বিপরীতে।সি আর দাশ তাঁকে সাহায্য করতে চাইলে অস্বীকার করেন তিনি। দেশজুড়ে সবার নজর ছিল এই কেন্দ্রে কি হয়।শেষ পর্যন্ত দেখা যায় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কে প্রায় তিন হাজার এর বেশি ভোটে পরাস্ত করে জয় পান তিনি।এরপর গান্ধীজির সাথে সাথ দিয়ে আইন অমান্য আন্দোলন ৎকরার সময় কারাবাস করেছিলেন কিছুদিন।ভিয়েনাতে চিকিৎসা চলাকালীন নেহেরু তাকে আহ্বান জানান উত্তর প্রদেশের গভর্নর হওয়ার জন্য। কিন্তু ফিরে এসে যখন দেখেন ওই পদে সরোজিনী নাইডু আসীন তখন আর সেই পদটিতে বসতে চাননি তিনি। রাজনীতিতে আসার পরই আশুতোষপুত্র শ্যামাপ্রসাদের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল তাঁর।১৯৫৩ সালে কাশ্মীরে বন্দী থাকাকালীন মৃত্যু হয় শ্যামাপ্রসাদের।গুজব রটেছিল যে বিধান রায়ের ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে তাঁর।ফলত তাদের প্রিয় ডাক্তারবাবুকে ঘৃণ্য গালিগালাজ করতে এবং বাড়িতে আগুন লাগাতে পিছু পা হয়নি কতিপয় জনতা। পরবর্তীতে শেখ আবদাল্লার কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন চেয়ে পাঠালে পরীক্ষা করেন দেখেন যে শ্যামাপ্রসাদের উচ্চরক্তচাপ ছিল এবং তা কমানোর বদলে উচ্চ রক্তচাপ এর চিকিৎসা করেন সেখানকার ডাক্তার।শ্যামাপ্রসাদের দেহ বাড়িতে আসলে তাঁর মা তখন আক্ষেপ করে বলেছিলেন তুমি থাকতেও মরতে হল আমার শ্যামাকে।

 

মুখ্যমন্ত্রী ‌হবার সময়ে  তার মাসিক আয় ছিল ৪২০০০টাকা। মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর তা করেন ১৪০০০টাকা।রাইটার্স যাবার আগে প্রতিদিন তিনি কুড়িজন করে রোগীর চিকিৎসা করতেন।এর জন্য নিজের পকেট থেকে অর্থ খরচ করে আরো দুজন সহকারী সহ প্যাথোলজির ব্যবস্থাও করেন।যদিও তৎকালীন সময়ে তাঁকে বিন্দুমাত্র অপদস্ত করতে ছাড়েনি কমিউনিস্ট রা।কলকাতার প্রত্যেকটা দেওয়ালে সাঁটিয়ে দেওয়া হয় "সাবধান হও কুলনারীগণ/মসনদে বসেছে নলিনী বিধান"।এছাড়াও তিনি মদ্যপ উপযুক্ত লোককে সম্মান দিতে জানেন না এসব তো ছিলই।

ছোটবেলা থেকেই অনুরাগী ছিলেন সি আর দাশের। তাঁর মৃত্যু পর যথেষ্ঠ ভেঙে পড়েছিলেন।এইসমময় হঠাৎই ঠিক করলেন সি আর দাশ এর নামে ফান্ডিং করবেন।যেই ভাবা তো কাজ চলে গেলেন চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য এর কাছে এবং অনুরোধ করলেন কবিতা লিখে দেওয়ার জন্য।কবি রাজি না হওয়ায় বললেন অপেক্ষা করব এরপরই সৃষ্টি হল সেই অমোঘ লাইন "এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/মরণে তুমি তাহাই করে গেলে দান।"

 

সক্রিয় রাজনীতি করার জন্য বেশ কাছে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর কাছে। উভয়ের মধ্যে প্রায়ই চলত পত্রযুদ্ধ। কলকাতার ডাব ও রসোগোল্লা বেশ‌ প্রিয় ছিল প্রধানমন্ত্রীর যা পাঠাতেন ডাক্তারবাবু। প্রধানমন্ত্রীর অসুখ করলে অনেক সময় প্রতিনিয়ত বিমানে নিত্য যাত্রীদের মতো দিল্লী গিয়ে চিকিৎসা করতেন তাঁর।একবার নেহেরু বিধানচন্দ্র রায়ের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন বাংলার সমস্যা কি কি?তখন বিধান রায় জানান বাংলার সমস্যা মূলত তিনটে মাথাগোঁজার ঠাই‚ রুজিরোজগার‚খাওয়া দাওয়ার সমস্যা।

 

একবার মতিলাল নেহেরু গান্ধীজি সরোজিনী নাইডু এর সাথে চা পান এর সাথে কিছু একটা বিষয়ে আলোচনা করছিলেন বিধান বাবু। তাঁর বয়স তখন প্রায় ৫০ এর একটু বেশি। হঠাৎ ই সরোজিনী দেবী বলে উঠলেন আপনার এতো বয়স তবুও হাসলে টোল পড়ে।ডাক্তারবাবু উত্তর দিলেন আমি হাসলে টোল পড়ে এবং তা বুঝি বয়স্ক রমণীদেরও আকৃষ্ট করে।উত্তর টা পেয়ে বেশ লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলেন সরোজিনী দেবী।তবে সরোজিনী দেবীর মেয়ের সাথেও ঘটেছিল মজার ঘটনা। বিধান বাবু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বাংলার রাজ্যপাল ছিলেন পদ্মজা নাইডু।এই নিয়ে তৃতীয় বার হার্ট অ্যাটাক হল তাঁর। রাইটার্স ছেড়ে বাড়িতেই চিকিৎসাধীন তিনি। অসুস্থ মুখ্যমন্ত্রী কে দেখতে এসেই রাজ্যপাল পদ্মজা নাইডু মুখ্যমন্ত্রী কে বললেন আপাতত কারোর সাথে দেখা করবেন না আপনার শরীর বেশ খারাপ।বিধান বাবু বললেন আমি চিকিৎসক এই ব্যাপারে আমি ভালো বুঝব। হঠাৎ মাথায় খেলে গেল বুদ্ধি।বলে উঠলেন আমি এই রাজ্যের রাজ্যপাল।আর একজন মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপালের কথা শুনতে বাধ্য।আমি রাজ্যপাল হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী কে নির্দেশ দিচ্ছি তিনি সবকিছু ঠিকঠাক মেনে চলবেন।

 

ডাক্তার হিসাবে একদিকে ভালোবাসা যেমন পেয়েছিলেন রাজনীতিতে থাকার জন্য জুটেছিল অপবাদ। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে আগুন লাগানো হয়েছিল বাড়িতে।মদ্যপ চোর এইসব তকমা পেতে হয়েছিল জীবদ্দশায়।আঘাত পেলে কখনো প্রকাশ করতেন না।একমনে ভাবতেন কর্নেল লুকিস এর কথা গুলো।আর কখনো কখনো বাবা মায়ের কথা।সমগ্র জীবন দিয়ে উপলদ্ধি করেছিলেন যারা চিরকাল নিন্দা করবে তারাও মৃত্যুকাল এ বলবে লোকটা বড়ো ভালো ছিল গো।'

ছবি সংগৃহীত 

You can share this post!

Leave Comments